16-01-2018 12:33:48 PM
অভুয়া শিপমেন্টের কাগজপত্র জমা দিয়ে টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে, এ প্রক্রিয়ায় সব পক্ষই জড়িত * অবিশ্বাস্য হলেও নতুন এ ফর্মুলায় দেশ থেকে দুর্নীতির বিপুল অর্থ নিরাপদে পাচার হচ্ছে * দুদকের অনুসন্ধানসহ হাইপাওয়ার কমিটি করে দ্রুত তদন্ত চান বিশেষজ্ঞরা। এ ফর্মুলায় এলসিকৃত কোনো পণ্যসামগ্রী দেশেও আসছে না। প্রশ্ন হল- তাহলে অর্থ কিভাবে পাচার হচ্ছে? অনেকটা অবিশ্বাস্য হলেও সোজাসাপটা উত্তর- প্রভাবশালী মহল পণ্য জাহাজীকরণের কাগজ জাল করে এলসিকৃত পণ্যের পুরো টাকাই তুলে নিয়ে বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। আর এটি সম্ভব হচ্ছে দেশের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের নীরব সমর্থন থাকায়। এ সুবাদে বিদেশে অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ কিনতে সক্ষম হয়েছেন। বিনিয়োগের কোনো অনুমোদন না থাকলেও ইতিমধ্যে তারা বিদেশে অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সেক্টরের বিগ দুর্নীতিবাজদের বিপুল পরিমাণ অর্থও চলে যাচ্ছে এ চ্যানেলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরের কাছে এমন বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র এবং কয়েকজন ব্যাংক বিশ্লেষক।এদিকে এমন ভয়াবহ অভিযোগ ভেতরে ভেতরে বেশ কিছুদিন থেকে চাউর হওয়ার পর প্রথম সারির কয়েকজন ব্যাংক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক জানিয়েছেন, সরকারের উচিত হবে বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করে দেখা। সন্দেহভাজন ব্যাংকগুলো বিশেষ করে গত ১-২ বছরে যেসব ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো যাচাই করে দেখা। তাদের মতে, সব পক্ষ চাইলে এভাবে পাচার হওয়া অবাস্তব কিছু নয়। কারণ ব্যাংক দেখে ডকুমেন্ট। ব্যাংক কোনো পণ্যসামগ্রী দেখে না। আর সেই কাগজপত্র যদি জাল হয় এবং যেসব স্থান থেকে পণ্য আমদানির তথ্য যাচাই করার কথা সেখানে যদি না থাকে বা গায়েব করে দেয়া হয়, তাহলে তো কেউ এলসিকৃত পণ্যের সন্ধান করবে না। আর যিনি কোনো পণ্য জাহাজীকরণ না করে পুরো টাকা বিদেশে রেখে এসেছেন তার তো পণ্য তালাশ করার প্রশ্নই ওঠে না।র্থ পাচারের ক্ষেত্রে এবার ভয়াবহ এক ফর্মুলার সন্ধান মিলেছে। যেখানে মিথ্যা ঘোষণা দেয়ার মতো কিছুই ঘটছে না। ধার ধারছে না ওভার ইনভয়েসিং কিংবা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের। এলসির মাধ্যমে কোনো পণ্য না এনে পুরো টাকাই বিদেশে রাখা হচ্ছে,
তারা মনে করেন, সরকার চাইলে সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি দিয়ে তদন্ত করলে অর্থ পাচারের ভয়াবহ এ অভিযোগ সঠিকভাবে তদন্ত করে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। মূলত চারটি বিষয় যাচাই করলে খুব সহজে পাচারের তথ্য পরিষ্কার হবে। যেমন- বাংলাদেশের শিপিং এজেন্টের ডুকুমেন্ট তথা জাহাজিকরণের কাগজপত্র, পণ্য ছাড়করণ সংক্রান্ত কাস্টমসের বিল অব এন্টি পেপারস, সংশ্লিষ্ট এলসি ওপেনিং ব্যাংকের নথিপত্র এবং সবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারের তথ্য যাচাই। বর্তমানে এর সবই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। অনেক তথ্যই এক সার্ভার থেকে অন্য সার্ভারে এন্টি হয়। কিন্তু আমদানিকৃত পণ্যের এলসি সংক্রান্ত তথ্য যদি সার্ভারে না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে বিপদটা সেখানেই ঘটেছে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অভিযোগের তদন্ত হওয়া উচিত। এটা সরাসরি জালিয়াতি। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মিলে এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে আইনি সহায়তা দিতে পারে আইন মন্ত্রণালয়। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারে দুদকে। সব মিলিয়ে আইনানুগ তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থপাচার বন্ধ করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এ বিষয়ে ভালোভাবে তদন্ত করা দরকার। দেখা যাবে তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপও বেরিয়ে আসতে পারে। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সহায়তা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। তার মতে, যেহেতু অভিযোগ উঠেছে সেহেতু সরকারকে এটি তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে জনমনে সন্দেহ আরও বাড়বে।
বিশিষ্ট ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছিল। এটা সরসরি জালিয়াতি। বিভিন্ন পক্ষের যোগসাজশে এমনটি করা হয়। তিনি কিছুটা স্মৃতিচারণ করে বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে এ ধরনের একটি ঘটনা ধরা পড়ে। আসার কথা ছিল তেলভর্তি জাহাজ, এসেছে পানিভর্তি জাহাজ। আর নতুন এ ফর্মুলায় তো কিছুই আনা হচ্ছে না (!) মূলত সুশাসনের ঘাটতির কারণে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তদন্ত করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঋণপত্র বা এলসি খোলার সময় ওভার ইনভয়েসিং কিংবা আন্ডার ইনভয়েসিং করে বিদেশে অর্থ পাচার করার অভিযোগ বা ফর্মুলা সেকেলে এবং আংশিক সত্য। তাছাড়া টাকা পাচার ছাড়াও আমদানি শুল্কের বোঝা কিছুটা কমাতে অনেকে আন্ডার ইনভয়েসিং করে থাকেন।
এছাড়া হুন্ডি করে টাকা পাচার আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় পরিমাণে খুব বেশি অর্থ পাঠানো যায় না। আর আন্ডার ইনভয়েসিং করলে টাকা বিদেশে পাচার করা হয় না। হুন্ডিতে যে টাকা পাঠানো হয় সে টাকার পণ্যও দেশে আনা হয়। এছাড়া ক্ষমতা কিংবা সুযোগ থাকলে কেউ কেউ বিমানে যাওয়ার সময় সরাসরি লাগেজভর্তি করে ডলার বিদেশে নিয়ে যান। তবে এ সুযোগও খুব কম। গার্মেন্ট বা অন্য কোনো পণ্য রফতানি করে কারসাজির মাধ্যমে তার একটি অংশ বিদেশে রেখে আসেন। তবে এভাবেও বেশি টাকা রেখে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু টাকা পাচারের উদ্বেগজনক নতুন যে ফর্মুলার বলা হচ্ছে, সেটি সম্ভব হলে বড় অংকের পাচার অনায়াসে করা সম্ভব।
বাল্ক পরিমাণে অর্থ পাচারের অজানা ফর্মুলা : সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এলসি প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যাংকগুলো আমদানি পণ্যের ডকুমেন্ট ছাড়া কখনও ফিজিক্যালি পণ্য বা মালামাল দেখে না। এটিই নিয়ম। তাই নিয়মানুযায়ী যখন কেউ এলসি খোলেন তখন ওপেনিং ব্যাংক বিদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট পাঠিয়ে থাকেন। সেখানকার নেগোশিয়েটিং ব্যাংক থেকে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট যে কেউ ডকুমেন্ট রিসিভ করেন। এরপর তিনি বিল অব লোডিং পেপারসসহ পণ্য জাহাজিকরণের সব কাগজপত্র সংযুক্ত করে ওই ব্যাংকে জমা দেন। কিন্তু এখানে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে যেটি করা হচ্ছে, তা হল ব্যাংকে জমা দেয়া এ সংক্রান্ত কাগজপত্র সবই জাল। আর এ কাজটি যারা করেন তাদের কাছে এটি তেমন কোনো কঠিন বিষয় নয়। বিশেষ করে দুবাই ও সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে এভাবে অর্থ পাচার করা খুবই সহজ। এ পন্থায় টাকা পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ সম্পৃক্ত। অভিযোগ রয়েছে, যাদের কেউ কেউ ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছেন। ইতিমধ্যে বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
জানা যায়, বিদেশের নেগোশিয়েটিং ও মেইন ব্যাংক থেকে আমদানি পণ্য জাহাজিকরণের ডকুমেন্ট পুনরায় বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাংকে আসার পর নিয়মানুযায়ী যিনি এলসি খুলেছেন, তিনি টাকা জমা দিয়ে পণ্য ছাড়ানোর ডকুমেন্ট নিয়ে যান। এখানে ব্যাংকের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। বিপরীতে বিদেশের নেগোশিয়েটিং ব্যাংক থেকে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার দেশের মুদ্রায় অর্থ তুলে নেন।
এদিকে এলসি যিনি খুলেছেন তিনি যেহেতু বিদেশে পুরো টাকাই বাল্ক আকারে পাচার করেছেন, তাই তিনি আর ডকুমেন্ট নিয়ে তার পণ্য ছাড়াতে কোনো কাস্টমসে যান না। আর বাস্তবে তো তিনি কোনো পণ্য বা যন্ত্রাংশ আমদানিই করেননি। এসব কারণে এ চক্রের হোতারা বছরের বেশির ভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করেন।
প্রশ্ন হল- এভাবে কেউ টাকা পাচার করলেও ৬ মাস পর তো বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিংয়ে ধরা পড়ে যাবেন। কেননা, যিনি এলসি খুলে বিদেশ থেকে পণ্য বা যন্ত্রাংশ আমদানি করেন তাকে কাস্টমস থেকে পণ্য রিলিজসংক্রান্ত বিল অব একচেঞ্জ পেপারস বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৬ মাসের মধ্যে জমা দিতে হয়। সূত্র বলছে, সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা নিয়ে এসব করা হচ্ছে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, এলসি মনিটরিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা কিংবা তাদের কেউ কি সার্ভার থেকে এলসি ডকুমেন্ট ডিলিট বা গায়েব করে দিতে পারবেন? যদি এটি সম্ভব হয় তাহলে পণ্য না এনে পুরো টাকায় বিদেশে এ পন্থায় পাচার করার মতো আর কোনো সহজ পদ্ধতি থাকতে পারে না। আর এভাবে যে কোনো অংকের অর্থ পাচার করা সম্ভব।