09-01-2018 10:35:08 AM
‘ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেড। ইউনিট: দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি।’ পাশে বাঘ মার্কা দেশলাইয়ের একটি ছবি। মরচে ধরা আর অস্পষ্ট সাইনবোর্ড পড়তে এখনো অসুবিধা হয় না। তবে ফটক দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে কারখানার কোনো আলামত নয়, চোখে পড়বে সবজি চাষ। লাউ থেকে শুরু করে শিমসহ বিভিন্ন সবজি। আছে কলাগাছও।
সবজির বাগান রেখে আরেকটু হাঁটলেই দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির মূল কারখানা ভবন। জানালার ভাঙা অংশ দিয়ে উঁকি দিতেই যন্ত্রপাতির দেখা মিলল। তবে যন্ত্রপাতি নয়, এগুলোকে যন্ত্রপাতির কঙ্কাল বলাটাই শ্রেয়। কারণ, পড়ে থাকতে থাকতে মরচে ধরে কোনো যন্ত্রের চেহারারই ঠিক নেই। আরেকটু এগিয়ে চার-পাঁচটি অকেজো গাড়ির দেখা মিলল। সেগুলোর গায়ে অবশ্য স্পষ্ট করে লেখা ঢাকা ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ।
গত বৃহস্পতিবার খুলনার রূপসা স্ট্র্যান্ড রোডের দাদা ম্যাচ কারখানায় গিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেল। গত ২০১০ সালের আগস্ট থেকে কারখানাটি বন্ধ আছে। তবে একসময় প্রজাপতি, জোড়া ঘোড়া, ট্যাক্সি, টাইগারসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দেশলাই উৎপাদন হতো। রূপসা নদীর তীরে ১৭ দশমিক ৭৯ একর জায়গার ওপর এই কারখানার যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৫ সালে।
বর্তমানে বন্ধ মিলের অকেজো যন্ত্রপাতি ও সম্পদ পাহারা দেন চারজন নিরাপত্তাকর্মী। তবে সাড়ে সাত বছর ধরে তাঁরা কোনো বেতন পান না। জেলা প্রশাসন থেকে মাসে ৩০ কেজি চাল বরাদ্দ আসে। আবারও কারখানা চালু হবে, এমন আশাতেই আঁকড়ে আছেন—বললেন নিরাপত্তাকর্মী আফজাল হোসেন। ১৯৮২ সাল থেকে দাদায় কাজ করছেন। তিনি বলেন, তাঁরাই সবজির চাষ করেন।
সাংবাদিক এসেছেন শুনে হাজির হয়েছেন কারখানার সাবেক শ্রমিক প্রয়াত দেলোয়ার হোসেনের ছেলে হারুনুর রশীদ। অভিযোগ করলেন, প্রায়ই মিলের যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক-দেড় বছরের মধ্যে সব যন্ত্রপাতি চোরের পকেটে চলে যাবে। একাধিকবার হাতেনাতে চোর ধরে পুলিশে দিয়েও লাভ হয়নি। জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার চুরি শুরু করে।
দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ১৯৭৩ সালে জাতীয়করণ হয়। তারপরই শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) মিলটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। তখন শ্রমিক ছিলেন আড়াই হাজারের কাছাকাছি। কারখানা ছিল লাভজনক। তবে ১৯৮৪ সালে ৩০ শতাংশ শেয়ার নিজেদের কাছে রেখে সুইডিশ এক কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে বিসিআইসি। পরে সুইডিশ কোম্পানিটি ফ্যাক্টরি চালাতে অপারগতা জানালে ১৯৯৩ সালে ভাইয়া গ্রুপ মিলের মালিকানা নেয়। তখন শ্রমিক ছাঁটাই করে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেও কারখানাটিকে লাভজনক করতে পারেনি। সে জন্য ২০১০ সালে মিল বন্ধ করে দেয় ভাইয়া গ্রুপ। তখন ৪৮৫ জন স্থায়ী ও দেড় হাজারের মতো বদলি শ্রমিক ছিলেন। বন্ধের পর ভাইয়া গ্রুপের সঙ্গে দেনদরবার করেও কারখানাটি চালু করতে ব্যর্থ হয় বিসিআইসি। পরে ২০১১ সালে সেটি অধিগ্রহণ করে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। বর্তমানে কারখানাটি জেলা প্রশাসনের জিম্মায় আছে।
নিরাপত্তাকর্মী আফজাল হোসেন বলেন, কারখানা তিন শিফটে (পালা) চলত। দিনে ২০-২২ হাজার গ্রোস (এক গ্রোসে ১৭২৪টি) দেশলাই উৎপাদিত হতো। তারপরও চাহিদা মেটানো যেত না। কারখানা থেকে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় ট্রাক দেশলাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেত। তবে বন্ধের আগে দিনে চার থেকে পাঁচ হাজার গ্রোস দেশলাই উৎপাদিত হতো।
দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ হলেও কারখানার দায়দেনা আছে ২৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া আছে ছয়-সাত কোটি টাকার। সেই বকেয়ার দাবিতে ৯০টি শ্রমিক পরিবার এখনো কারখানার কোয়ার্টারে বসবাস করছে। তবে ৫৬ লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করায় গত দেড় বছর ধরে পুরো কারখানা চত্বর ও কোয়ার্টার অন্ধকারে আছে। সে জন্য পানির পাম্পও চলে না।
ভাইয়া গ্রুপের হয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে কারখানায় কর্মরত আছেন মতিউর রহমান। সরকার অধিগ্রহণ করলেও তিনি রয়ে গেছেন। তিনি বললেন, ‘বেতন বাবদ আমার চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা বকেয়া আছে। এসব পরিশোধ করলেই আমরা চলে যাব। শ্রমিকেরাও বকেয়া মজুরি পেলে কোয়ার্টার ছেড়ে দেবেন।’ তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ-পানির অভাবে কারখানার শ্রমিকেরা পরিবার নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছেন। কেউ দায়দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
মতিউর রহমান বলেন, কারখানাটি চালু করার বিষয়ে ২০১৩ সালে সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বিসিআইসিকে নির্দেশ দেন। পরে অবশ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বর্তমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে এসে বন্ধ মিল চালুর বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে ফ্যাক্টরির সাবেক মালিকপক্ষ মামলা করার বিষয়টি নিয়ে জটিলতার কথাও বলেন শিল্পমন্ত্রী।
জানতে চাইলে খুলনার জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান গত শনিবার বলেন, ‘দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি জেলা প্রশাসন দেখভাল করে, তবে বিসিআইসি কোনো বরাদ্দ দেয় না। আমরা আইটি পার্ক বা সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে কারখানাটি ব্যবহারের জন্য বহুবার চিঠি দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারখানার সাবেক শ্রমিক কিছু টাকা পাবেন। পানি ও বিদ্যুৎ নেই। টাকাপয়সা পরিশোধসহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও বিসিআইসিকে অনুরোধ করেছি। তবে কোনো উদ্যোগ নেই।’