06-01-2018 11:35:59 AM
থালা, বাটি, চামচ, জগের মতো পণ্যের জন্য একটা সময়ে সাধারণ মানুষ পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল মাটির তৈরি তৈজসপত্রে। এরপর কাঁসা-পিতল, চীনামাটি, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক, ইস্পাত, কাচের তৈরি তৈজসপত্র মানুষের ব্যবহারের তালিকায় জায়গা করে নেয়। আর হাল আমলে উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে মেলামাইনের তৈরি তৈজসপত্র।
মেলামাইন তৈজসপত্রের উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিত্যনতুন নকশা, টেকসই কাঠামো ও সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে মেলামাইন তৈজসপত্রের চাহিদা ও বাজার দিন দিন বাড়ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে মেলামাইন পণ্য। কয়েকজন বেসরকারি উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি দেশে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এরপর গত তিন দশকে এই পণ্যের বাজার যেমন বেড়েছে, তেমনি যুক্ত হয়েছে নতুন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
মেলামাইন পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (এমপিএমইএ) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বড় আকারের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে ১০টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শরীফ, ইটালিয়ানো, বাংলাদেশ, ডায়মন্ড, তাজ, কেয়া, ডায়না, শরীফ মেলামাইন প্রভৃতি। এর বাইরে পুরান ঢাকাভিত্তিক কিছু ছোট কারখানা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। উৎপাদন, বিপণন মিলিয়ে এ খাতে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সংখ্যা ১০ হাজার। সব মিলিয়ে বছরে মেলামাইন তৈজসপত্রের বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে ৭০০ কোটি থেকে ৮০০ কোটি টাকার। প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে এ বাজার বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রথম মেলামাইন তৈজসপত্র পণ্য উৎপাদন শুরু করে বাংলাদেশ মেলামাইন। দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী নাসির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হলো এটি।
এই বাজারে এখন সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান শরীফ মেলামাইন। ১৯৮৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্যবসায়ী রজ্জব শরীফ। শরীফ মেলামাইনের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আছেন ৩ হাজারের বেশি লোক। থালা, বাটি, চামচ, গ্লাস, জগের মতো প্রচলিত গৃহস্থালির তৈজসপত্র ছাড়াও শিশু ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য মেলামাইন পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে শরীফ মেলামাইন। শিশুদের জন্য শরীফের রয়েছে ‘প্রিন্সেস’, ‘অ্যাংরি বার্ডস’, টম অ্যান্ড জেরি চরিত্রের ছবিযুক্ত বিশেষ থালা। আরও আছে জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র মীনার ছবিযুক্ত মগ। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, সুইডেন, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ মোট ১৪টি দেশে বর্তমানে শরীফ মেলামাইনের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। নতুন রপ্তানি বাজার ধরতে ও পণ্যের প্রচারণা বাড়াতে প্রতিবারই বেশ জাঁকজমক করে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এবারও দেড় হাজারের বেশি পণ্যসম্ভার নিয়ে বাণিজ্য মেলায় অংশ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
শরীফ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক খন্দকার জিয়াউল বাশার বলেন, তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে শরীফ মেলামাইন তার শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। কিছু ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের পণ্য তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। এতে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন এবং বাজারে তা একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অনেক পরে শুরু করেও মেলামাইন তৈজসপত্রের বাজারে খুব শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল। ২০১২ সাল থেকে ইটালিয়ানো ব্র্যান্ড নামে মেলামাইন তৈজসপত্র বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। হবিগঞ্জের নিজস্ব কারখানায় ২৭টি শ্রেণিতে নানা রং ও নকশার প্রায় দুই হাজার ইটালিয়ানো পণ্য উৎপাদন করে আরএফএল। এর মধ্যে আছে বাটি, চামচ, মগ, কাপ-পিরিচ, ডিনার সেট, স্যুপ সেট, ফিরনি সেট, গিফট সেট ইত্যাদি। দেশের সীমা ছাড়িয়ে ইটালিয়ানো ব্র্যান্ডের মেলামাইন পণ্য নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, সেনেগাল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ৩০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ইটালিয়ানো ব্র্যান্ড বাজারে আসার আগে মেলামাইনের পণ্যে তেমন বৈচিত্র্য ও পার্থক্য ছিল না। প্রাণ-আরএফএল বাজারে এসে এ ধারার পরিবর্তন এনেছে। এখন পণ্যের মানও আগের চেয়ে বেড়েছে। সব মিলিয়ে এ বাজারে একটি বড় গুণগত পরিবর্তন এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেলামাইন তৈজসপত্রের বাজার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু পণ্যের দাম একই পর্যায়ে থাকায় ও প্রতিযোগিতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় সেভাবে বাড়ছে না। আবার মেলামাইন তৈজসপত্র উৎপাদনের কাঁচামাল সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। মেলামাইনের তৈজসপত্র উৎপাদনে মূলত তিনটি কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। এগুলো হলো মোল্ডিং পাউডার, শাইনিং ও পেপার। মোল্ডিং দিয়ে বিভিন্ন আকারের তৈজসপত্রের কাঠামো তৈরি হয়। এরপর বিভিন্ন নকশার পেপার বা কাগজ সেঁটে দেওয়া হয়।
এমপিএমইএ মহাসচিব শাহজাহান আলী বলেন, ‘কাঁচামালের উচ্চ আমদানি শুল্কের কারণে চীনের সঙ্গে রপ্তানি বাজারে আমরা পেরে উঠছি না। এখন কাঁচামাল আমদানিতে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর দিতে হয়। আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১ শতাংশ করা হলে রপ্তানি অনেক বাড়ানো সম্ভব।’ কারখানা করার জন্য প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তাদের প্লটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেন তিনি।