১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস। যুদ্ধে পরাজয় আসন্ন জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ-দেশীয় সহযোগীরা জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশার অংশ হিসেবে সারা দেশে কত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণীত হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের আগে পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে পুনর্মুদ্রিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কিত তথ্যকোষ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ২৩২ জন উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই তালিকাটি সর্বমোট নয়, এমনকি সম্পূর্ণও নয়। বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তারসহ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনা ঘটে। এ হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল মূলত জাতি হিসেবে আমাদের মেধাহীন, পঙ্গু করে দেওয়া। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর ১৮ ডিসেম্বর ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধিজীবী হন্তারকদের চিহ্নিত করা, কী প্রক্রিয়ায় বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কতজনকে হত্যার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, এই অপকর্মের পরিকল্পনাকারী, সহযোগী কারা ছিল— এ রকম সব তথ্য খুঁজে বের করা। দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গোপন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে ১৮ ডিসেম্বর একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে, রায়েরবাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষতবিক্ষত লাশের একটি গণকবরের সন্ধান পায়। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একে-অন্যের নিচে চাপা পড়ে ছিল। লালমাটিয়ায় শারীরিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একটি বন্দীশালা আবিষ্কার করে, যা ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ও কামালউদ্দিন, চিকিত্সক ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, আবুল খায়ের এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতারের পচনশীল লাশ তাদের পরিবার সেদিনই শনাক্ত করে। সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের লাশ শনাক্ত করা হয় পরদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ফাইজুল মহি এবং চিকিত্সক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলীর লাশ পরে চিহ্নিত করা হয়। লাশ শনাক্তকরণের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। এ রকম আরও বধ্যভূমি ছিল মিরপুর ও রায়েরবাজার, তেজগাঁওয়ের কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি বি হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক লাশই পরে শনাক্তকরণের পর্যায়ে ছিল না। এ সময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পাক হানাদার বাহিনী এ-দেশের তরুণ-যুবকদের হত্যা শুরু করেছিল একাত্তরের ২৫ মার্চের পরই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য। পরে বিশেষ করে ডিসেম্বরের শুরু থেকে তারা দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে হত্যা করতে থাকে। ডিসেম্বরের ১২ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। মূলত যুদ্ধের নয় মাসজুড়েই চলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এমনকি পাকবাহিনীর দোসরদের (রাজাকার, আলবদর, আলশামস) দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় ১৯৭২-এর জানুয়ারিতেও। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও খোদ ঢাকা শহরেই কিছু এলাকা হানাদার ও তাদের দোসরদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশ স্বাধীন হলে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার অপহূত ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। পাকবাহিনী তাকেও হত্যা করেছিল বলে ধারণা করা হয়। তাকে শেষ দেখা যায় মিরপুরে বিহারি ও পাকবাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে। পরে তার সম্পর্কে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ডা. মনসুর আলীকে ২১ ডিসেম্বর ও সাংবাদিক গোলাম রহমানকে ১১ জানুয়ারি হত্যা করা হয়। ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সে সময় বাংলা একাডেমি নীতিমালা করে যে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ কিছু পেশাজীবীকে ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। যে ২৫০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করা হয় তার অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোষগ্রন্থের নাম-ঠিকানা ধরে খোঁজ নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেশ কয়েকজনের নিকটাত্মীয়ের লেখা সংকলিত করে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ। ‘স্মৃতি-৭১’ প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং কোষগ্রন্থে প্রকাশিত তালিকার বাইরে অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়স্বজন তাদের তথ্য নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ পর্যায়ে এসে কোষগ্রন্থের তালিকাসহ প্রায় ৩২৫ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম বাংলা একাডেমির হাতে আসে। পরে একের পর এক ‘স্মৃতি-৭১’ প্রকাশিত হতে থাকে। এই গ্রন্থের দশম খণ্ড প্রকাশিত হয় ৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ সালে। দশম খণ্ডে স্থান পেয়েছে ১২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নিকটাত্মীয়ের স্মৃতিকথা। দশম খণ্ড পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ২৩৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের লেখা স্মৃতিকথা প্রকাশ করে। এর বাইরে বাংলা একাডেমি আর কোনো তালিকা সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে পারেনি। সরকারও আর কোনো শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এন এম মুনির চৌধুরী, ডা. জি সি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুল মুক্তাদীর, এস এম রাশিদুল হাসান, ডা. এ এন এম ফাইজুল মাহি, ফজলুর রহমান খান, এ এন এম মনিরুজ্জামান, ডা. সেরাজুল হক খান, ডা. শাহাদাত আলীসহ অনেকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কাইয়ূম, হাবিবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমদ্দার, মশিউর রহমান, আমজাদ হোসেন, আমিনুদ্দিন, নাজমুল হক সরকার, আবদুল হকসহ অনেকে। সাংবাদিক— সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, খন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দিন আহমেদ, এ এন এম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, সেলিনা পারভিনসহ অনেকে। চিকিত্সক— মো. ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, সামসুদ্দিন আহমেদ, আজহারুল কবীর, সোলায়মান খান, কায়সার উদ্দিন, মনসুর আলী, গোলাম মর্তোজাসহ অনেকে। শিক্ষাবিদ— জহির রায়হান, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, ফেরদৌস দৌলা, ইন্দু সাহা, মেহেরুন্নিসাসহ অনেকে। শিল্পী ও পেশাজীবী— আলতাফ মাহমুদ, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সামসুজ্জামান, মাহবুব আহমেদসহ অনেকে।