01-04-2018 01:36:58 PM
বিজেপিকে রুখতে মেরুকরণের ওপর জোর মমতার
মমতা চাইছেন কংগ্রেসকে বাইরে রেখে একটা ফ্রন্ট’ গড়তে
প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই স্বপ্ন যে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে, এবারের দিল্লি সফরে সেই উপলব্ধি নিয়েই তাঁকে রাজ্যে ফিরতে হচ্ছে। তবু তাঁর চেষ্টার অন্ত নেই। খেলা শেষ হওয়ার আগে ফল নিয়ে চিন্তায় মাথা ঘামাতে তিনি এখনই রাজি নন।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপিকে রুখতে মমতা যে ধরনের মেরুকরণের ওপর জোর দিচ্ছেন, এই মুহূর্তের বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে তাকেই প্রায় অসম্ভব মনে করা হচ্ছে। মমতা চাইছেন কংগ্রেসকে বাইরে রেখে একটা ‘ফেডারেল ফ্রন্ট’ গড়ে তুলতে। সেই ফ্রন্টের শরিকেরা সবাই বিজেপির বিরুদ্ধে একজন করে সর্বসম্মত প্রার্থী দেবে। যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী, সিদ্ধান্তের অধিকারী হবে তারাই। এভাবে ‘একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী’ দেওয়া ফেডারেল ফ্রন্টকে সরকার গড়তে কংগ্রেস বাইরে থেকে সমর্থন দিক।
মমতার ধারণা, বিজেপি-বিরোধিতায় কংগ্রেসের যা অবস্থান, তা বজায় রাখতে গেলে এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় শতাব্দীপ্রাচীন দলটার নেই। ইচ্ছা না থাকলেও ওই ভূমিকা পালনে তারা বাধ্য।
এই রাজনৈতিক অঙ্ক যে অলীক কল্পনা, তত্ত্বগতভাবে এই অঙ্ক মেলানো এই মুহূর্তের রাজনৈতিক আবহে যে বৃত্তকে চতুষ্কোণে পরিণত করার মতোই কঠিন, এবারের দিল্লি সফরে তৃণমূলেশ্বরীকে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই দিক থেকে এই সফর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এক অর্থে বোধোদয়।
বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ে কংগ্রেসকে যে বাইরে রাখা অসম্ভব, তা অত্যন্ত সহজ ভাষায় স্পষ্ট করে মমতাকে বলে দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার। একই কথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ও উত্তর প্রদেশের দুই প্রধান শক্তি সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির। বিহারের প্রধান শক্তি রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মনোভাবও তা। তাদের নেতা লালুপ্রসাদ জেলে থাকলেও দলটা এখনো চলে তাঁরই নির্দেশে। ফেডারেল ফ্রন্টের জন্য মমতা যাঁদের ওপর ভরসা করছেন, সেই তেলেগু দেশম পার্টি নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু অথবা তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয়
সমিতির নেতা চন্দ্রশেখর রাও এখনো কংগ্রেস নিয়ে তাঁদের মনোভাব খোলাসা করেননি। অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা দুই রাজ্যেই বিজেপির মতো কংগ্রেসও তাদের প্রতিপক্ষ। কিন্তু বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেসকে বাইরে রেখে ফ্রন্ট গড়ার তত্ত্বে যে চিড়ে ভিজবে, তা মানতে এখনো এই দুই দল রাজি নয়। সেই একই রকম দোলাচলে ওডিশার শাসক দলের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও।
কংগ্রেস নিয়ে দোলাচল যে মমতারও নেই, তা নয়। কিন্তু সেই দোলাচলের হেতু পুরোটাই ব্যক্তিগত। কংগ্রেসের আদর্শেই মমতার জন্ম। তাঁর দলের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনো দিক থেকেই কোনো রকমের বিরোধ নেই। আড়ষ্টতা যা কিছু, তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সেই ব্যক্তি রাহুল গান্ধী। রাহুল কংগ্রেসের সভাপতি হতে পারেন, কিন্তু বিজেপিবিরোধী জোটের নেতা হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে প্রবল আপত্তি মমতার।
মমতা মনে করেন, রাহুলের বয়স কম। তা ছাড়া বিজেপির বিরুদ্ধে তিনি যে ধরনের আন্দোলন করেছেন ও করছেন, সেই নজির রাহুলের নেই। এই যে ‘মেন্টাল ব্লক’, এটাকেই মমতা অতিক্রম করতে পারছেন না। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না, ২০১৯ সালে বিজেপিকে সরানো গেলে রাহুল হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
অথচ বাস্তব ছবিটা মমতাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন শরদ পাওয়ার।
মমতার মতো শরদ পাওয়ারেরও জন্ম কংগ্রেসে। কংগ্রেসের আদর্শের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনেরও কোনো ফারাক নেই। কংগ্রেসের হয়ে দেশ শাসনের স্বপ্ন তাঁরও ছিল। সেই স্বপ্নতাড়িত হয়েই একদা তিনি সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। দলত্যাগও। কিন্তু রাজনীতিটা বাস্তবের জমির ওপর দাঁড়িয়ে করেন বলেই কংগ্রেসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেননি। কংগ্রেস ছাড়লেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধাকে তিনি অস্বীকার করতে পারছেন না। মমতাকে অঙ্ক কষে সেটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। বলেছেন, এবারের কংগ্রেসের সঙ্গে গতবারের কংগ্রেসের যেমন তুলনা টানা যায় না, তেমনই ২০১৪ সালের বিজেপির সঙ্গে ২০১৯-এর বিজেপিরও তফাত বহু যোজনের। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বা বাইরে রেখে কোনো বিজেপিবিরোধী জোট অসম্ভব।
কেন অসম্ভব, সাধারণ পাটিগণিতই তার প্রমাণ। জম্মু-কাশ্মীর থেকে শুরু করে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি ও তার সহযোগীদের একমাত্র প্রতিপক্ষ কংগ্রেস ও তার মিত্রশক্তি। এই রাজ্যগুলোতে ১২৯টি আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি ও তার শরিকদের ঝুলিতে এসেছিল ১১৫টি আসন। আগামীবার ওই আসনে বড় ভাগ বসাবে কংগ্রেস। এর বাইরে রয়েছে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক। এই দুই রাজ্যেও কংগ্রেসকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। একই রকম অসম্ভব গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিহার ও ঝাড়খন্ডে। শরদ পাওয়ারের অনুরোধ তাই, কংগ্রেস নিয়ে মমতা যেন অতটা ঋজু ও অনমনীয় না হন।
তা যে তিনি নন, সেটা বোঝাতেই সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে মমতা এবার দেখা করেছেন। সেই বৈঠকে রাহুল ছিলেন না। কিন্তু মমতাকেও সোনিয়া এ কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন, রাহুলকে বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তাঁর নেই। মমতাকে তিনি বলেছেন, বিজেপিবিরোধী জোট গঠন নিয়ে যা কিছু প্রস্তাব, সব তিনি কংগ্রেস সভাপতিকে জানাবেন। বুঝিয়ে দিলেন, তিনি রাহুলের মা হতে পারেন, কিন্তু কংগ্রেসের সভাপতি তাঁর পুত্র রাহুলই।
লোকসভায় কংগ্রেসের আসন এখন ৪৮। এক বছর পর সংখ্যাটা ১০০ ছাড়ালে বিজেপিবিরোধী জোটের নেতৃত্বে রাহুল গান্ধীকে কী করে অস্বীকার করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? প্রশ্নটা উঠে গেছে। উত্তরটাও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর জানা। তবে ভাঙলেও এখনই মচকাতে তিনি রাজি নন।