27-01-2018 02:09:12 PM
* শুধু গান গেয়ে শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেন তাঁরা।
* কেউ প্রথম গানে বাজিমাত করেছেন।
* কাউকে অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েকটা গান পর্যন্ত।
* বাংলা গানে এখন অনেকটাই অনিয়মিত তাঁরা।
মামুন, আবিদা সুলতানা, আজমেরী নির্ঝর, নোলক, মাহাদী, রাশেদ, শাকিলা সাকি, তৌসিফ, আনিলা, শিরিন, নাজিয়া পারভিন। তাঁদের কেউ তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কেউবা একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। শুধু গান গেয়ে শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেন তাঁরা। কেউ প্রথম গানে বাজিমাত করেছেন, কাউকে অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েকটা গান পর্যন্ত। পেশাদার গানে তাঁদের সবার বয়স এক দশকেরও বেশি। অথচ বাংলা গানে এখন অনেকটাই অনিয়মিত তাঁরা। কেউ আবার পেশা বদল করেছেন। ‘সুনীল বরুণা’, ‘রূপের মাইয়া’, ‘একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও’, ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’, ‘মা’, ‘প্রজাপতিটা যখন-তখন’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’—এসব গান কণ্ঠ দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের গানে আগমন ঘটে বেশ কজন তরুণ তুর্কীর।
২০০২ সালে ‘রূপের মাইয়া’ শিরোনামে একটি গান প্রকাশিত হয়। সিলেটের মামুনের গাওয়া গানটি কিছুদিনের মধ্যেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে মামুনের নাম। লোকগানের এই শিল্পীর শুরুটা ছিল বাংলাদেশ বেতারে গান করার মধ্য দিয়ে। অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, মামুনের গাওয়া ‘রূপের মাইয়া’ গানের ক্যাসেট ৪০ লাখ বিক্রি হয়। এরপর আরও কয়েকটি একক গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হলেও তা প্রথম সাফল্যকে ছাড়াতে পারেনি। সিলেটের ছেলে মামুন এখন বেশির ভাগ সময় থাকেন লন্ডনে।
আজমেরী নির্ঝর যখন ‘একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও’ গানটি গেয়েছিলেন, তখন তিনি লালমাটিয়া মহিলা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। ২০০৫ সালে হাবিব ওয়াহিদের কম্পোজিশনে আশা ভোঁসলের গাওয়া গানটি নতুন করে গেয়ে নজর কাড়েন নির্ঝর। গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিলেও ওই সময় পড়াশোনার জন্য লন্ডন চলে যান তিনি। ইস্ট লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ এবং অক্সফোর্ড ব্রুকস থেকে এসিসিএ শেষ করে ২০১০ সালে দেশে ফিরে আবারও গানে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করেন। দেশে ফেরার পর ‘জানি একদিন’ ও ‘আজকের এই নিশি’ গানগুলো নির্ঝরকে আলোচনায় নিয়ে আসে। তাঁর সর্বশেষ একক অ্যালবামের ‘স্বপ্নমুখীর আরাধনা’ গানটিও জনপ্রিয়। এত কিছুর পর নির্ঝরকে অনেক দিন দেখা যাচ্ছে না গানে। জানা গেছে, নির্ঝর এখন আছেন প্যারিসে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রকল্পে সংগীত শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। বললেন, ‘নিজের উন্নতির জন্য দেশের বাইরে যাই। আমার মনে হয়েছে, গানের বাইরে শিক্ষাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গানকে ভালোবাসি বলেই ছয় মাস পরপর ঢাকায় আসতাম। একপর্যায়ে মনে হলো, আমাকে আরেকটু উন্নতি করতে হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য ২০১২ সালে আবার সুইডেন যাই।’
নির্ঝর বলেন, ‘একসময় আমি মেডিটেশনের সঙ্গে সংযুক্ত হই। এখানে যুক্ত হওয়ার পর আমার উপলব্ধি হলো, শুধু সংগীতশিল্পী হিসেবে নয়, মানুষকে ভালো কিছু দেওয়ার সুযোগ আছে। এই ভাবনাকে সঙ্গী করে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় মেডিটেশনকে ছড়িয়ে দিচ্ছি। গান থেকে বেরিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়েছে, মেডিটেশন নিয়ে কাজ করলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। এটা ঠিক, গানের ক্ষেত্রে আমি নিজেও উদাসীন ছিলাম।’
ঘটনাটা ২০০৭ সালের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবিদা সুলতানা। ওই সময় অর্ণবের সুরে ‘প্রজাপতিটা যখন-তখন উড়ে উড়ে’ গানটি করেন। এটি ছিল তাঁর গাওয়া প্রথম গান। গানটি তরুণেরা দারুণভাবে গ্রহণ করে। গানটি দেশের তরুণেরা গ্রহণ করলেও গানে অনিয়মিত থেকে যান আবিদা। কী কারণে গানে নিয়মিত হননি? আবিদা বললেন, ‘বিয়ে, সংসার আর সন্তানদের কারণে হয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া আমার যোগাযোগ অতটা ছিল না। আমিও ওভাবে লাইম লাইটে ছিলাম না। সংগীত পরিচালকদের তো মনে রাখতে হবে, কে আছে কে নেই। আমার নিজের কারণে এটাই হয়েছে।’
আবিদা সুলতানা এখন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংগীত প্রযোজক। জানালেন, গান নিয়ে নতুনভাবে ভাবছেন। কয়েকটি গান তৈরি হয়ে আছে। বললেন, ‘টেলিভিশন চ্যানেলের সংগীত প্রযোজক হিসেবে সারা দিন কাজ করতে হয়। চ্যানেলটি এখনো নতুন, তাই সময় অনেক বেশি দিতে। নতুন কিছু ভাবতে হয়। কয়েকটি গান জমা আছে, কীভাবে করব, সেটা নিয়ে ভাবছি।’
আবিদা জানান, ১১ বছরে চলচ্চিত্র ও মিশ্র অ্যালবাম মিলিয়ে ১০টি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
২০০৫ সালে রিয়্যালিটি শো ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে গানের জগতে আসেন জামালপুরের নোলক বাবু। ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘শোয়াচান পাখি’ গান দুটি দিয়ে নিজেকে চিনিয়ে দেন। দর্শকের ভালোবাসা আর বিচারকের রায়ে চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর নোলকের গাওয়া ‘চালচুলোহীন স্বপ্ন’ গানটি দর্শকপ্রিয়তা পায়। প্রতিযোগিতা থেকে বের হওয়ার তিন বছর পর এই গানের মাধ্যমে নোলক নিজের জায়গা আরও পোক্ত করেন। এরপর যেন ছন্দপতন হয়। যে সম্ভাবনা নিয়ে নোলক সংগীতাঙ্গনে এসেছিলেন, তাতে ভাটা পড়ে। ব্যক্তিগত নানা ঘটনা, বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকায় শুরুতেই তাঁকে ঘিরে আলোচনা থেমে যায়।
নোলক বলেন, ‘প্রতিযোগিতার পর আমার মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ওই সময় অনেক কিছুই বুঝতে পারিনি। পরিবেশ পরিস্থিতি সামলে এগিয়ে যেতে পারিনি। আমার কোনো ভালো পরামর্শক ছিল না। তাই যেভাবে কাজ করার দরকার ছিল, সেভাবে করতে পারিনি।’
নোলক জানান, এখন তিনি আবার আগের মতো ব্যস্ত হতে চান। সেভাবেই গানের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় ‘মা’ গানটি গেয়ে সবার বাহবা কুড়ান চট্টগ্রামের ছেলে রাশেদ। শওকত আলী ইমনের সুর ও সংগীতে রাশেদের গাওয়া গানটি আজও দর্শক হৃদয় নাড়ায়। এক যুগ আগে যে গান দিয়ে দর্শক হৃদয় জয় করেছিলেন রাশেদ, আজ তিনি কোনো আলোচনায় নেই।
গানটির সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন বলেন, ‘হঠাৎ কেউ আলোচনায় এলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধরে রাখা মুশকিল। তবে একজন প্রতিভাবান শিল্পীর শ্রোতাপ্রিয় গান প্রকাশের পরও তার থেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে সুরকার ও সংগীত পরিচালকের দায় আছে।’
শওকত আলী ইমন আরও বলেন, ‘ইদানীং আমরা দেখি, বেশির ভাগ সংগীত পরিচালকই শিল্পীর কণ্ঠ-উপযোগী গান করেন না। যেমন রাশেদ যে ধরনের গান গেয়ে সবার ভালোবাসা পেয়েছিলেন, সে আর সেই সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছে? “মা” গানের পর তো সে আমার কাছে আসেনি! এখানে আরেকটা বিষয় দেখা যায়, একজন শিল্পী যে সুরকার ও সংগীত পরিচালকের গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পান, তখন তাকে বাদ দিয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য সুরকার ও সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে শিল্পীকে উদ্বুদ্ধ করে।’
২০০৫ সালে গানের জগতে আরেক গায়কের দেখা মিলেছে। ‘সুনীল বরুণা’ শিরোনামের গান গেয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন। এরপর ‘হৃদয়ের ঝড়ে’, ‘নিঝুম রাত’, ‘ভোরের শিশির’সহ আরও কয়েকটি গানে মাহাদী তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। শ্রোতার হৃদয়ে গানগুলো দারুণ মায়া ছড়ায়। এত কিছুর পরও এই গায়ক এখন গানের জগতে একেবারেই নেই। কারণটা তাঁর নিজেরও অজানা।
মাহাদী বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, গানে একটা যুগের পরিবর্তন হয়েছে। একসময় কণ্ঠনির্ভর শিল্পীদের ভালো দাপট ছিল। গত শতাব্দীতে দেখা গেছে, গায়কের পাশাপাশি সুরকার ও সংগীত পরিচালকেরা কাজ করছেন। ভবিষ্যতে দেখা যাবে, কণ্ঠশিল্পী কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সংগীত পরিচালক যদি শিল্পী হন, তখন সেরা গানটা তিনি নিজেই গাইতে চান। একসময় কণ্ঠশিল্পীরা যতখানি পরিচিত পেয়েছেন, তখন কিন্তু পেছনের মানুষগুলো তা পাননি। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে আক্ষেপ তৈরি হতো। সংগীত পরিচালকদের যখন প্রযুক্তি সমর্থন দেওয়া শুরু করেন, তখন তাঁরা শিল্পী হয়ে যান। আমি তো শুধু কণ্ঠশিল্পী।’
মাহাদী আরও বলেন, ‘আমি এতটা সময় কণ্ঠের লালন করে এসেছি। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আমার কম্পোজার হওয়া সম্ভব না। আমি যে একটা গান করব, তাহলে তো একজন সুরকার ও সংগীত পরিচালকের কাছে যেতে হবে। একটা সময় মনে হয়েছে, আমার তো জীবন আছে। জীবনের জন্য অর্থের দরকার। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি চাকরি বেছে নিই।’
দুই বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ গান দিয়ে বাজিমাত করেন শাকিলা সাকি। বছর দুয়েক ধরে গানটি অনেকের মুখে মুখে। ১০ বছর ধরে গানের জগতে থাকলেও প্রথম হিট গানের দেখা পেতে কয়েক বছর লেগে যায়। শাকিলা সাকি প্রথম চলচ্চিত্রে গান করেন ২০১১ সালে। ছবির নাম ‘পাগল তোর জন্য রে’। আর দ্বিতীয় ছবি ‘ছুঁয়ে দিলে মন’। চলচ্চিত্রের গানের আগে অডিও মাধ্যমেও গান করেছেন। গানে নিয়মিত নন কেন? শাকিলা বলেন, ‘আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারি না। তাই পিছিয়ে আছি। তবে আমি আমার মতো করে মঞ্চে গান করছি।’
শাকিলা আরও বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল চলচ্চিত্রের গান করব। দ্বিতীয় ছবিতে সেই সাফল্য আসার ব্যাপারটা বিরাট সৌভাগ্যের। বাংলাদেশের আনাচকানাচে পৌঁছে গেছে এই গান। স্টেজ শো করতে গিয়ে তার প্রমাণ পাই।’
গত এক দশকে যে কজন শিল্পী তাঁদের গান দিয়ে আলোচনায় ছিলেন, কিন্তু এখন অনিয়মিত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম তৌসিফ, আনিলা, শিরিন, নাজিয়া পারভিন প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে তৌসিফকে মাঝেমধ্যে গান প্রকাশে দেখা যায়। আর অন্যরা প্রবাসজীবন থেকে দেশে এলে হঠাৎ করে গান নিয়ে ভাবেন। আর কেউ তো শুধু প্রবাসজীবনে নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত আছেন।