বাংলাদেশ | বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ,১৪৩১

খোলা কলাম

06-12-2017 09:13:13 AM

একটি পাঞ্চাবী ও কোর্টের কাহিনী

newsImg

জীবনটা কত কষ্টের এবং নির্মম আকুল তা বুঝতে পারলো ঢাকার আসার পর । পুরো নাম আসদাত প্রধান আকুল । লালমনিরহাট থেকে ২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকায় আসে ।“নিজের খরচে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে বড় চাকুরী করবে” এমনি স্বপ্ন দেখতো আকুল ।
ঢাকার একটি প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আকুল কাজ খুঁজতে থাকে ।কিন্তু দিনের বেলায় ক্লাস থাকায়, সান্ধকালীন কোন কাজই পেল না । এদিকে মেসের খরচ চার হাজার টাকা আকুলের বাড়ি থেকে দেওয়া অসম্ভব ।
তাই একটানা বিশ দিন কাজ খুঁজতে লাগলো । একুশতম দিনে আকুল একটি পুরোনো পাঞ্চাবী পড়ে বের হয়েছে ।পাঞ্চাবীটা এক আত্মীয় দিয়েছিলো ।আকুলের মা প্রায়ই বলতেন “ আকুল তোমাকে এই পাঞ্চাবীটা পড়লে খুব সুন্দর লাগে । আকুলের বন্ধুরাও একই কথা বলতো । মা ও বন্ধুদের ছেড়ে আসা আকুলের ঢাকায় বসে কথাগুলো খুব মনে পড়ে ।তাই আকুলের খুব শখ একটা নতুন পাঞ্চাবী পরিধান করে মা ও বন্ধুদের সামনে যাবে ।
একুশম দিনে তিন হাজার টাকার কাজ পেল আকুল ।মেস খরচ চালানোর জন্য স্বল্প বেতনের চাকুরি নিতে বাধ্য হল । বেশ কয়েকমাস বন্ধুদের থেকে ধার করে ও বেতনের টাকা দিয়ে চলতে থাকে আকুল । ঈদের আগের মাসে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে বেশ কিছু টাকা উপার্জন করে । টাকা হাতে পেয়ে এবার তার চিন্তা পরিবারের সকলকে নতুন কাপড় কিনে দেবে । যথারীতি সবার জন্য নতুন কাপড় কিনলো ।শেষে আমাকে বললো “সোহাগ টাকাতো সব শেষ,ভেবেছিলাম আমার একটা পাঞ্চাবীও কিনব” । আমি বললাম“দুঃখ করিস না বন্ধু,কয়েকদিন পর আবার কিনতে আসবো” ।
তার বেশ কিছুদিন পর আকুল পড়াশোনার চাপে সেই কাজটি ছেড়ে দিল ।কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর সে অনুধাবন করতে পারলো কাজ ছাড়া শুধু পড়াশোনা করা তার পক্ষে অনুকূল নয় ।তাই আবারো হন্যে হয়ে কাজ খুঁজতে থাকে ।
দেখতে দেখতে একটি বছর কেটে গেলো । আকুল এখনো তার আত্মীয়র দেওয়া সেই পাঞ্চাবীটাই পড়ে ।।তার অসহায়ত্ব দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো । কিন্তু ভাল একটা পাঞ্চাবী কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমারও ছিল না ।
দ্বিতৃয় বছরের পঞ্চম মাসে আকুল আবারো অল্প বেতনের কাজ পেল । সেই মাসের শেষে যখন চার হাজার টাকা বেতন পেল তখন ঢাকায় আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলা চলছিল । ছুটির দিনে আকুলকে সাথে নিয়ে মেলায় গেলাম ।অনেক হাটাহাটির পর আকুল কোর্টের দোকানে গিয়ে থামলো । আমাকে বললো “সোহাগ দেখো দোকানের ভিতরে লেখা ‘কোর্টের মূল্য ছাড় দাম মাত্র তেরশ’ ।আমি বললাম “কিনবে কি”? আকুল উত্তর দিল “সোহাগ, বাবা রোজ ২৬ কি.মি. সাইকেল চালিয়ে রোজগার করেন ।এই শীতের মধ্যে না জানি তিনি কত কষ্টের ভিতর আছেন । বাবাকে এরকম গরম কোর্ট কিনে দেওয়ার খুব ইচ্ছে । কিন্তু টাকা নেই । এই মাসে যা পেয়েছি তা দিয়েতো মেস খরচই ঠিকভাবে হবে না “ ।কথাগুলো বলতে বলতে আকুলের চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো ।আমিও আর ঠিক থাকতে পারলাম না ।অশ্রুসজল চোখে বললাম “তুই এই কষ্টের সুফল একদিন পাবিই,দুঃখ করিস না দোস্ত ।
আকুল তার বাবার সম্পর্কে প্রায়ই বলতো । তার বাবা ছিল প্রচন্ড আবেগী ।একদিন বলছিল একটি গরম কোর্ট কিনে দিলে তার বাবা এতই খুশি হবে যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না ।আমি ভাবতেছি যে ছেলে নিজের পাঞ্চাবী কিনতে পারছে না,যা তার অন্যতম শখ ছিল,সেই ছেলে তা ভুলে বাবাকে কোর্ট কিনে দেওয়ার কথা ভাবে কি করে?
বেশ কয়েকমাস পর একদিন আকুলের মেসে গিয়ে দেখি কাজে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে ।পড়নে সেই পাঞ্চাবীটা,এখন আরো পুরোনো এবং ছিঁড়ে গেছে । আমি বললাম “ এই ছেড়া পাঞ্চাবীটা পড়েছিস কেনো? উত্তরে বললো, দোস্ত আজকে মায়ের কথা খুব মনে পড়তেছে,তাই মায়ের পছন্দর পোশাকটা পড়েছি’ ।
সোহাগ,ভাবতেছি সামনের শীতে মেলা থেকে বাবার জন্য একটা গরম কোর্ট কিনব । সেজন্য মাসে পঞ্চাশ টাকা করে জমা করতছি ।
এই ঘটনার দুই মাস পর পড়াশোনার প্রচন্ড চাপে এবং শারীরিক অসুস্থতর জন্য চাকরিটা আবার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় আকুল ।শুনলাম গ্রামের বন্ধুদের থেকে টাকা ধার নিয়ে মেস খরচ চালাচ্ছে ।ইতিমধ্যে ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুরু হয়েছে ।মেলা চলাকালীন সময়ে একদিন আকুলের মেসে গিয়ে দেখি অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে আছে। বললাম ‘চল মেলায় যাবো’ । আকুল বললো, মেলায় গেলেই বাবার জন্য খারাপ লাগবে,কোর্টটা যে কিনতে পারবো না সেটি নিশ্চয় জানিস । পাল্টা প্রশ্নে বললাম আর পাঞ্চাবীটা?
অশ্রুসজল চোখে আকুল বললো,সোহাগ একটি পাঞ্চাবী ও কোর্ট দুই বছরেও কিনতে পারলাম না !

সাব্বির হোসেন সোহাগ
ইতিহাস বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা ।

খবরটি সংগ্রহ করেনঃ- আই-নিউজ২৪.কম
এই খবরটি মোট ( 6546 ) বার পড়া হয়েছে।
add

Share This With Your Friends