06-11-2017 03:04:02 PM
খুলনা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এ শহরের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় নাম ছিল শিল্পনগরী। কিন্তু আশির দশকে সরকারের কিছু ভ্রান্ত নীতির কারণে শিল্পকারখানাগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হতে থাকে। কিন্তু আস্তে আস্তে খুলনা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। পাটকলগুলো আবার সচল হতে শুরু করেছে। বেসরকারিভাবেও কিছু পাটকল উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু সরকারি হার্ডবোর্ড মিল, নিউজপ্রিন্ট মিল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি বেসরকারি মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দক্ষ বাজারজাতকরণের অভাবে মিলগুলো এই হাইপার কম্পিটেটিভ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি সময় ছিল যখন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল নিজ দেশের চাহিদা পূরণ করে কাগজ বিদেশে রপ্তানি করত। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা সম্ভব।
অন্যান্য শহর থেকে এ শহরের প্রধান পার্থক্য খোলা ড্রেন। শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ ড্রেনই খোলা এবং কাঁচা। যার ফলে প্রতিটি ড্রেনই পরিষ্কার করার কয়েক দিনের মধ্যেই আবার কাদাপানিতে ভরে যায় এবং পানি চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে একটু বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। খুলনা শহরের ১৫ লাখ নগরবাসীর জন্য ১৭ হাজার রিকশা প্রতিদিন চলাচল করে এবং সঙ্গে আছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব রিকশা ও ইজিবাইক মালিকদের রিকশা ও ইজিবাইক রাখার নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। তাই প্রতিটি রিকশা, ইজিবাইক বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় রাস্তার দুই ধারে দিনে-রাতে সব সময় আড়াআড়িভাবে পার্ক করে রাখে। এমনিতেই রাস্তার প্রশস্ততা কম, তার ওপর এভাবে রিকশা রাখার জন্য নগরবাসীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। অনেক সময় বিভিন্ন মোড়ে দোকান ও হোটেলের টেবিল-চেয়ার এবং পণ্য রাস্তায় রেখে ব্যবসা করতে দেখা যায়। সিটি করপোরেশনের রাস্তার ওপর এভাবে পণ্য, রিকশা, ইজিবাইক রাখার কোনো বিধান নেই। অথচ সিটি করপোরেশন ইচ্ছা করলেই এসব রিকশা ও ইজিবাইকের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ভাড়া দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে।
সিটি করপোরেশনের হিসাবমতে, নগরীতে ৩৫৭ কিলোমিটার রাস্তার অধিকাংশই বিভিন্ন খানাখন্দে ভরা এবং মেরামত করার এক বছরের মধ্যে আবার নষ্ট হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ জলাবদ্ধতা। এমনকি প্রধান প্রধান সড়কেরও একই অবস্থা। তাই যেসব সড়কে পানি জমে, সেসব রাস্তা পিচ এবং বিটুমিনের বদলে সিমেন্ট-বালি এবং পাথর দিয়ে ঢালাই দিলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। প্রধান প্রধান সড়কে নেই পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং, যত্রতত্র রাস্তা পার হতে গিয়ে নগরবাসী প্রায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। খুলনা শহরের নিউমার্কেট, ডাকবাংলোসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় ফুটওভার ব্রিজের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
শহরের প্রধান প্রধান সড়ক এবং পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে বিভিন্ন সাইনবোর্ড, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন সারা বছর ঝুলতে থাকে। এতে করে নগরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। অথচ সিটি করপোরেশন এসব ব্যনার, ফেস্টুন, সাইনবোর্ডের স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়ে এ থেকেও রাজস্ব আদায় করতে পারে। নগরে নগরবাসীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা এবং রুট বৃদ্ধি করা হয়নি। নগর পরিবহনগুলোতে লোকজন গাদাগাদি করে প্রতিদিন চলাফেরা করছে। নগর পরিবহনগুলো চলাচলের জন্য তিন যুগ ধরে একই রুট নির্ধারিত রূপসা টু ফুলতলা। অথচ ফুলতলা থেকে জিরো পয়েন্ট, ডাকবাংলো থেকে জিরোপয়েন্ট, দৌলতপুর, মুজগুন্নি, সোনাডাঙ্গা হয়ে রূপসা—এই রুটেও নগর পরিবহন এখন সময়ের দাবি।
নগরের পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা অপ্রতুল, বর্তমানে যে কয়টা আছে তার অবস্থাও নাজুক এবং অপরিষ্কার। ভ্রাম্যমাণ মানুষ এ জন্য প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছে। জনবহুল স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করে সিটি করপোরেশন এ থেকেও রাজস্ব আদায় করতে পারে। নগরে বিনোদন কেন্দ্রের খুবই অভাব, নেই পর্যাপ্ত পার্ক এবং বাচ্চাদের খেলার জায়গা। নগরবাসীর হাঁটার জন্য নেই কোনো উন্মুক্ত সরণি। শুধু নগরবাসীর হাঁটার জন্য ঢাকার রমনা পার্কের মতো একটা পার্কের প্রয়োজন, যেখানে প্রতিদিন ডায়াবেটিস রোগীরা, স্বাস্থ্য সচেতন মানুষরা সকাল-বিকেলে হাঁটা, জগিং এবং দৌড়ঝাঁপ করে শরীর সুস্থ রাখতে পারেন।
খুলনা শহরে নেই কোনো ভালো শপিং কমপ্লেক্স। খুলনা শহরের জন্মলগ্ন থেকেই মাত্র দুটো মার্কেট নিউমার্কেট ও ডাকবাংলো। যুগের পর যুগ শহরবাসী এ দুই মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে থাকেন। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মানের কোনো শপিংমল তৈরি করা হয়নি। যেখানে থাকবে ফুডকোর্ট, জিমনেশিয়াম, সুইমিংপুল, সিনেপ্লেক্স, বিনোদন এবং শপিংয়ের সব উপাদান। খুলনাবাসীর প্রাণের দাবি, একটি আন্তর্জাতিক মানের শপিং কমপ্লেক্স।
নগরবাসীর ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার জন্য নেই পর্যাপ্ত মাঠ। অবৈধ দখল, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খোলা জায়গা, মাঠ আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা যার যার নিজের বাসার সামনের রাস্তায় খেলাধুলা করার কারণে যাতায়াতের বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এ কারণে অনেক সময় প্রতিবেশীদের মধ্যে ঝগড়া, এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত শুরু হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি খেলার মাঠ নির্ধারণ করা যেতে পারে, যার তত্ত্বাবধানে থাকবে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। নগরীর ফুটপাতগুলো দখল। রাস্তার সামনের দোকানগুলো তাদের দোকানের মালামাল ফুটপাতের ওপর রেখে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছে। ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী।
বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় নেই পর্যাপ্ত ডাস্টবিন, যার ফলে নগরবাসী দৈনন্দিন বর্জ্য এখানে-সেখানে এবং রাস্তার ওপর ফেলে পরিবেশদূষণ এবং রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী করে তুলছে। সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশদূষণ, নষ্ট হচ্ছে নগরের সৌন্দর্য। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং নগরবাসী বৃদ্ধির জন্য যত্রতত্র গাড়ি, সাইকেল ও মোটরসাইকেল পার্ক করার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দরকার পার্কিং ব্যবস্থা।
খুলনা শহরকে আরো উপযোগী ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা। আধুনিক খুলনা মহানগর গড়তে খুলনা সিটি করপোরেশন, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা ওয়াসা, খুলনা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশনেরও আধুনিকায়ন প্রয়োজন এবং এসব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে খুলনার উন্নয়নে কাজ করবে। এ জন্য দরকার সরকারের আন্তরিকতা এবং নগরবাসীর সচেতনতা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।