22-08-2016 10:44:42 AM
ভেবেছিলাম, তিন দিনের মধ্যে বোনের বিয়ের কেনাকাটার মতো গুরুদায়িত্ব শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে যাব। এ কদিন সল্টলেক নিউ মার্কেট সিটি সেন্টার ঘুরতে ঘুরতে পায়ের তলা ক্ষয়ে আসার মতো অবস্থা। কলকাতায় আব্বুর বন্ধুর বাড়িতে এসে উঠলাম আর কী কপাল! সে বন্ধুই পরলোকে চলে গেলেন হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে। শ্রাদ্ধ শেষ না করে যাওয়াটাও বেখাপ্পা দেখাবে। আব্বুর এত দিনকার বন্ধু বলে কথা, তা ছাড়া আপার বিয়ের এখনো বেশ কিছুদিন বাকি। রয়ে গেলাম। চাচাতো ভাই আহসানও এসেছিল সঙ্গে। ওকে তিনটি বড় লাগেজ বুঝিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম দেশে। বেনাপোলে আব্বুর লোক থাকবে। সমস্যা হবে না। হিন্দুবাড়িতে কেউ মারা গেলে কেমন রীতিনীতি মেনে চলতে হয় জানি না, তাই বারান্দায় পাতা বড় বেঞ্চে চুপচাপ বসে রইলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, মৃত কমলেশ বাবুর বড় ছেলে অমল আর মেজ ছেলে বিমল নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে চাপা গলায় তর্ক করতে করতে মেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ছোট মন্দিরের পাশের ঝাঁকড়া জবাগাছতলায় তাদের তর্ক উত্তপ্ত বাক্যে রূপ নিল মুহূর্তেই। কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম কিছু পাচ্ছিলাম না। ‘এ জন্যই বলেছিলাম আগে থেকে খুলে রাখতে, তখন তো কেউ শুনলে না!’ অমল বললেন। মেজ ছেলে বিমলের কণ্ঠেও ঝাঁজ—‘কখন এই কর্ম হলো বুঝতেও তো পারলাম না। আইসিইউতে নেওয়ার সময় নার্সকেও বললাম খুলে দিতে, কিন্তু তখন কী ওদিকে নজর দিচ্ছিল কেউ? যমে-মানুষে টানাটানি!’ ‘হুহ! নজর যার দেওয়ার সে দিয়েছে। সে-ই জিনিসটা গাপ করেছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি।’ ‘কে? মা?’ ‘দূর! সে তো কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছে। আরে বুঝলি না? ছোট নিয়েছে!’ ‘সুনীল!’ ‘তা ছাড়া আর কে!’ আবার ঝাঁঝ চড়ল অমলের গলায়, ‘বাবার পোশাক আজ সকালে পাল্টাল কে—মা আর সুনীল। মা যখন শোকে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গেল, সুনীল এলো আমাদের খবর দিতে। আসলে মায়ের অজ্ঞান হওয়ার ফাঁকেই ও অপকর্মটা করেছে—বুঝলি?’ ‘হুম! আগে শ্রাদ্ধটা শেষ হয়ে যাক, তারপর ওকে ক্যাঁক করে ধরব। এখন আর টুঁ শব্দটিও করা যাবে না। লোকে ছে ছে করবে যে!’ ‘হুম, তা-ও যা কথা। বেলা অনেক গড়াল। শ্মশানের কী ব্যবস্থা হলো চল দেখে আসি গে।’ অমল-বিমল চলে গেলে আমি বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মোটামুটি যা শুনলাম, তাতে বোঝা গেল, কমলেশ বাবুর দেহ থেকে মূল্যবান কিছু একটা চুরি হয়েছে। না, শুধু মূল্যবান নয়, মনে হয় মহামূল্যবান। আর এ সম্পর্কে সুনীলই ভালো বলতে পারবে। আমি দেরি না করে সুনীলের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। সুনীলকে পাওয়া গেল ছাদে। ও আমার দুই বছরের ছোট। কিন্তু এই বয়সেই ভারি চেইন স্মোকার! আমাকে দেখতে পেয়ে প্রথমে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকাল, তারপর অভ্যস্ত হাতে পাজামায় ফিতার জায়গায় বটে রাখা দেশলাই বক্স বের করে সিগারেট জ্বালাল। ঠিক আমাদের দেশে কামলারা লুঙ্গিতে যেমন গুঁজে রাখে। কী বলে শুরু করব বুঝতে পারলাম না, বোকার মতো বলে বসলাম—‘তুমি যে সিগারেট খাও, এ কথা এ বাড়ির কেউ জানে না, তাই না?’ সুনীল প্রথমে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তার পরই হেসে উঠে বলল, ‘জানে। কিন্তু সবাই ভান করে—আমি যে সিগারেট খাই তারা এটা জানে না, আমিও ভান করি—তারা যে এটা জানে সেটা আমি জানি না! হা হা হা!’ অবাক হলাম! বাবা মারা গেছেন অথচ শোকের একটু ছায়াও ওর মধ্যে নেই। আমি মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করলাম। জানি না, আমার হাসির মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিল। ও জানতে চাইল—‘আপনি ছাদে এসেছেন আমাকে কিছু বলার জন্য, তাই না?’ চমকালাম এবং মাথা নেড়ে সায় জানালাম। সুনীল মুচকি হাসল—‘সেটা কী বাবার হারিয়ে যাওয়া জিনিসটা নিয়ে?’ এবার ভয়ানক চমকালাম! বাপ রে! এ তো বহুত চালাক। মাথা চুলকে বললাম, ‘কিন্তু তুমি কী করে জানলে যে আমি এ নিয়েই কথা বলতে এসেছি?’ সুনীল এবার গলা কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল—‘ওই যে বললাম? তলে তলে সবাই জানে অথচ ভান করে জানে না। বাবার ব্যাপারটাও তা-ই।’ ‘আমি আসলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না বলেই তোমার কাছে আসা। যদি কিছু মনে না করো, তাহলে আমাকে বলবে?’ এবার এতক্ষণকার সুনীল যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল, বেশ গম্ভীর হয়ে ঠোঁট গোল করে ধোঁয়ার রিং বানিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে দিতে লাগল। একটু পরেই সে বলল—‘বাবার কোমরের কাছে সব সময়ই একটা চেইন থাকত আর ওতে ঝোলানো থাকত নীল রঙের একটা পাথর। বাবা বলতেন ব্লু ডায়মন্ড, যদিও ওটা ডায়মন্ড নয় আসলে। কিন্তু ওটা যে খুব দামি রত্ন, তাতে সন্দেহ নেই। বেশ কয়েক পুরুষ ধরে ওটা হাতবদল হয়ে বাবার কাছে এসেছে। বাবাও আগলে রাখতেন যক্ষের ধনের মতো। দেশের বাইরে গেলেও ওটা এমন জায়গায় রেখে যেতেন যে আমাদের কারো নাগাল পাওয়ার সুযোগ থাকত না। কিন্তু হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় বাবা আর ওটার দিকে নজর দিতে পারলেন না। আমাদেরও নজর ছিল না। বাবাকে নিয়ে সবাই হসপিটালে ছুটছি তখন। তবে বাবাকে আইসিইউতে নেওয়ার সময় মেজদাই মনে করিয়ে দিল ওটা খুলে নেওয়ার কথা। মেজদার এমনিতেই ওটার ওপর বড্ড নজর ছিল। মেজদা যে লোভী, তা সে বুঝতে না দিয়ে চেঁচাচ্ছিল, মূল্যবান জিনিস, নার্সদের মধ্যেও কেউ গাপ করে দিতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই সবাই ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। কারণ, আমাদের সবার কাছে তখন রত্নের চেয়ে বাবার জীবনই বেশি মূল্যবান মনে হয়েছিল।’ সুনীল থামল। আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে বলকে বলকে ধোঁয়া ছোটাল আর বলতে শুরু করল, ‘নার্সগুলো ভালো ছিল, বাবার রত্ন খোয়া গেল না। বাবার মৃতদেহ যখন বাড়ি নিয়ে আসা হলো, তখনো সেটি তার কোমরে ছিল। এমনকি আমি আর মা মিলে যখন বাবাকে সৎকারের পোশাক পরাচ্ছিলাম, তখনো ওটা তাঁর কোমরে ছিল। কিন্তু...’ বুঝলাম, রহস্য ঘনীভূত হতে শুরু করেছে আর সুনীলের এই ‘কিন্তু’ থেকেই তা প্রকটভাবে বোঝা যাচ্ছে। সুনীল বলতে শুরু করল, ‘বাবার পোশাক পাল্টানো শেষ হলে মা হঠাৎ চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে যখন বুঝতে পারলাম, মায়ের জ্ঞান নেই, তখন বড়দাকে খবর দিতে ছুটলাম। দরজা খুলতেই দরজার ওপাশে বড়দাকে পেয়ে গেলাম। বড়দা মায়ের কাছে গেল আর আমি পানির গ্লাস আনতে ছুটলাম। আধা মিনিটের মতো লাগল মাসি-পিসিসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে মায়ের কাছে পৌঁছতে। মেজদাও সে সময় ঢুকল। পরে আমরা মেজদাকে বাবার মৃতদেহের কাছে রেখে সবাই মাকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলাম। মুখে পানি ছিটাতে লাগলাম। সে সময় শুনতে পেলাম মেজদার চেঁচামেচি—ওটা নেই! ওটা নেই! পাশের ঘর থেকে আবার ছুটলাম বাবার ঘরে। দেখলাম, বাবার মৃতদেহের কোমরে কাছে জামা গোটানো আর মেজদা হন্যে হয়ে রত্নটা খুঁজে চলেছেন। মেজদাকে বড্ড বেশি লোভী দেখাচ্ছিল। আমি রাগ করে সে ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে চলে আসি। এখন অবধি নামিনি।’ ‘হতে পারে তোমার মেজদাই চুরি করে পরে ভান করছিলেন, ওটা অন্য কারো হাতে খোয়া গেছে।’ ‘হতে পারে।’ সুনীল মাথা নাড়ল। ‘এটাও তো হতে পারে, বড় ভাই যখন প্রথমে তোমার মায়ের কাছে ছিলেন, তুমি সবাইকে ডাকতে গিয়েছিলে তখন তিনিই গাপ করেছেন।’ ‘হতে পারে।’ সুনীল একই হেঁয়ালি গলায় বলল। আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘ইয়ে মানে... এটাও হতে পারে প্রথমে তোমার মা যখন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলন তখন তুমিই... ইয়ে কিছু মনে কোরো না, এমনি বললাম আর কি...’ ‘হতে পারে!’ সুনীল আবারও হো হো করে হেসে উঠল, ‘রনি দাদা! সবই হতে পারে!’ আমি আর ওখানে দাঁড়ালাম না। চিলেকোঠা পেরিয়ে যখন নিচে নামছি, তখনো শুনলাম সুনীল হাসছে। অপ্রকৃতিস্থের হাসি। দিনটা একরকম কেটেই গেল। আত্মীয়স্বজন সবাই গিজগিজ করছে। শেষ দেখার মুহূর্ত এলো। আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে আঙ্কেলকে শেষ দেখা দেখে নিলাম। মুখটা শুকিয়ে গলাটা ঠেলে বেরিয়ে আছে। রাতে নির্দিষ্ট সময়ে তাকে নিয়ে সবাই চলল শ্মশানের দিকে। আন্টি গেলেন না। আমিও রাতের বাসে বাংলাদেশ ফিরব। আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেব ভাবলাম। দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখলাম, পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। হাতে একটা চেইন। ওতে একটা লুপও আছে, যেটা খালি। খুব সম্ভব এটা সেই চেইন, যা আঙ্কেলের কোমরে ছিল। আমি বিদায় নেওয়ার বদলে ফস করে বলে বসলাম—‘আন্টি রত্নটা আপনিই সরিয়ে রাখেননি তো, যাতে করে ওটা অন্য কারো হাতে না পড়ে?’ আন্টি প্রথমে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ভয়ানকভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন—‘সব ভস্ম হয়ে যাক! সব ভস্ম হয়ে যাক!’ আমি ওখান থেকে একরকম দৌড়েই পালালাম। চলে গেলাম শ্মশানে। সুনীলকে দেখতে পেলাম। চিতার আগুনের লালচে আলোয় ওর করুণ মুখটা দেখা যাচ্ছিল। আমিও নিঃশব্দে চিতার দহন দেখছিলাম। আর কানের কাছে বাজছিল আন্টির চিৎকার—‘সব ভস্ম হয়ে যাক!’ চিতার আগুন এখন প্রায় নিভু নিভু। ফিরে যাব এমন সময়ই মাথায় এলো—রত্নটা আসলে কার কাছে আছে। যদিও এর জন্য দুজন লোকের সাহায্য নিতে হলো। তাদের মধ্যে একজন সৎকারের কাজে থাকা মহাদেব, আরেকজন অটো ড্রাইভার রঞ্জিতলাল। এর পরের ব্যাপারটা আসলেই মনে রাখার মতো। দেশে ফিরেও অনেকবার ওই দৃশ্য চোখে ভাসছিল, যখন আমি রত্নটা আন্টির হাতে তুলে দিচ্ছিলাম আর তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছিল। পাঠক বলুন, কী করে বুঝলাম রত্নটা কার কাছে আছে। পরে কী করে সেটি উদ্ধার করলাম?