21-11-2017 11:23:11 AM
মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে ধর্ষণ করার যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা গত ১০০ বছরের বিশ্ব ইতিহাসে তো দূরের কথা, মধ্যযুগ ছাড়িয়ে প্রাচীনকালের ইতিহাস ঘাঁটলেও এমন জঘন্য নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করার জন্য সেদেশের সেনাবাহিনী যে কায়দায় ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং লোকজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার কৌশল অবলম্বন করছে তা দেখলে কুখ্যাত হালাকু খান কিংবা চেঙ্গিস খানও অনুশোচনায় আত্মহত্যা করতেন।
দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকা, সামাজিক মাধ্যম এবং টেলিভিশনে যেসব স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রোহিঙ্গা যুবক-যুবতী ও কিশোর-কিশোরীদের বিবস্ত্র করে বিশেষ কায়দায় ভূমি থেকে কিছুটা উপরে উঁচিয়ে এক ধরনের বাঁশ বা কাঠের কাঠামোর সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। তারপর ইচ্ছামতো অঙ্গচ্ছেদ, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি চালানোর পর হতভাগ্য নর-নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয় প্রকাশ্যে। সবচেয়ে নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং আশ্চর্যজনক এসব বর্বরতার ছবি তুলে সেনাসদস্যরা নিজেরাই তা প্রচার করে থাকে। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গারা দলে দলে দেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে অনেকটা স্বপ্রণোদিত হয়ে, ঠিক যেন ঝড়ের গতিতে। ২০১২ সালের মে-জুন মাসেও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশে ঢুকেছিল। কিন্তু তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানের ন্যায় উদারভাবে সীমান্ত খুলে দেয়নি। বরং সাধ্যমতো শক্তি প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করা হয়েছিল। এরই প্রেক্ষাপটে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমি ২০১২ সালের ১৮ জুন নাতিদীর্ঘ এক নিবন্ধ লিখেছিলাম— ‘অসহায় রোহিঙ্গা, সেক্যুলার অর্থমন্ত্রী এবং নাস্তিক শিক্ষামন্ত্রী’ শিরোনামে। নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের দলের কট্টরপন্থি নেতারা আমার বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কানভারী করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সরকার কিছুটা হলেও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সে যাত্রায় নমনীয় হয়েছিল এবং আমি ব্যক্তিবিশেষের রোষানল থেকে রেহাই পেয়েছিলাম।
২০১২ সালের নিবন্ধে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সে সময়ে মানবিক, দয়ালু ও কৌশলী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তিনি তখন তা করলে আজকের পরিস্থিতি হয়তো সৃষ্টি হতো না। তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমানের ক্রান্তিকালীন প্রেক্ষাপটে যে মানবিকতা, উদারতা এবং সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, তাতে নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতা ও কূটনৈতিক কৌশলের কারণে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তেমনি ভারত, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্র মিয়ানমারের ব্যাপারে তাদের দীর্ঘদিনের মনোভাব পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে এবং শুরু হয়েছে নানা মেরুকরণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন। খবরে পড়েছি ইউরোপীয় গণমাধ্যম আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধি দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন আগামীর নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকায় সংযুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
এমনিতেই প্রধানমন্ত্রীর বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। তার ওপর যদি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান তবে সরকার বিরোধীদের যে কী পরিমাণ অস্বস্তি এবং গাত্রদাহ শুরু হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রোহিঙ্গা ইস্যু হঠাৎ করে ইউটার্ন নিয়েছে। এই কিছুদিন আগে যারা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য কোমরে গামছা বেঁধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে হম্বিতম্বি শুরু করেছিলেন, তারা হঠাৎ করে ভোল পাল্টে প্রবল রোহিঙ্গাপ্রেমিকে পরিণত হয়েছেন। অন্যদিকে অনাদিকালের রোহিঙ্গাপ্রেমিকেরা নতুন প্রেমিকদের দাপটে কেমন যেন চুপসে গিয়ে চুবনি খাওয়া মোরগ-মুরগির মতো বাকরুদ্ধ হয়ে উদাসীনভাবে চারদিকে ইতিউতি করে তাকাচ্ছেন আর ভাবছেন— হচ্ছেটা কি?
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে পণ্ডিতেরা তাদের তাবৎ পাণ্ডিত্য উদ্গীরণ করে বোঝাতে চেষ্টা করছেন যে, কীরূপে এবং কখন রোহিঙ্গারা বাঙালির আত্মার বন্ধু ছিলেন। দাতারা ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন এবং সুবিধাবাদীরা নানা ছলছুতায় নিত্যনতুন সুবিধাভোগের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছেন। মানবতাবাদীরা অসহায় শরণার্থী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবেতর দুঃখ-যাতনা ও দুর্ভোগের কাহিনী শুনে এবং দেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জনের পাশাপাশি বিধাতার দরবারে নিজেদের আর্তি পেশ করে যাচ্ছেন। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগোষ্ঠী যে যার মতো করে বিষয় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। কিন্তু বৈশ্বিক রাজনীতির দাবার চালে বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি আগামী দিনে কী ভয়ানক বিপদে পড়তে যাচ্ছে— তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মানুষের সংখ্যা খুবই কম বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সিরিয়া ও ইরাকে যখন আইএস জঙ্গিরা পরাজিত হতে চলেছে তখন হঠাৎ করে কোরীয় উপদ্বীপ, জাপান সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগর অশান্ত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সরগরম হওয়ার মধ্যে বিরাট এবং ব্যাপক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু চীন, রাশিয়া এবং ভারতের রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভিন্ন সুরে কথা বলাটাও একটি অশনি সংকেত। মানবতার খাতিরে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মিয়ানমার নামক দেশটির কোনো ক্ষতি করেনি বরং উপকার করেছে। কিন্তু এসবের বিনিময়ে সীমান্তের অপর পারে যুদ্ধাবস্থা, মিয়ানমারের সামরিক হেলিকপ্টারের বার বার বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ এবং অপরপক্ষের হম্বিতম্বি শুভ লক্ষণ নয়। আমাদের পার্বত্য জেলাগুলো নিয়ে প্রায় হাজার বছরের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অনেক কিছু আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ জানেন না। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অঞ্চল এবং আমাদের পার্বত্য জেলাগুলোর ঐতিহাসিক সম্পর্ক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলো কোনো কালে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। আমরা নিতান্ত সাদামাঠাভাবে সব ঘটনার দায় মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেত্রী অং সান সু চির ওপর চাপিয়ে মনের ঝাল মেটাচ্ছি। কিন্তু কেউ একবারের জন্যও ভাবছি না যে, সু চির একচুল ক্ষমতা নেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি টুঁ শব্দ করার। এমনকি তিনি ইচ্ছা করলেও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলা তো দূরের কথা, পদত্যাগ অথবা আত্মহত্যা করতেও অপারগ। কাজেই বিষয়টি হালকাভাবে না নিয়ে আমাদের উচিত সীমান্তে কড়া জবাব দেওয়া এবং কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি তেমনভাবে মোকাবিলা করা— যেমনটি ইন্দিরা গান্ধী করেছিলেন আমাদের জন্য ১৯৭১ সালে। আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ রাখতে না পারলে বাংলাদেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাদের ফেরত পাঠাতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও বিপদ ও বিপত্তি বাড়বে। জাতিসংঘের ওপর নির্ভর না করে বৃহত্তর রাষ্ট্রশক্তিগুলোর মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়া বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদার হয়ে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে উত্থাপন করে মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে অদক্ষতামূলক আচরণ ও গাফিলতি দেখালে আজ রোহিঙ্গা রাজ্যে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে অনুরূপ দুর্ভোগ আমাদের দুয়ারে চলে আসতে খুব বেশি দেরি হবে না।