বাংলাদেশ | শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪ | ১৪ চৈত্র,১৪৩০

স্বাস্থ্য কথা

05-11-2017 03:52:04 PM

আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলো কেন গুরুত্বহীন!

newsImg

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ: আইসিডিআর,বির এক গবেষণায় গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে আর্সেনিকের প্রভাবের সঙ্গে ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে-এমন একটি আশঙ্কার খবর নিশ্চয়ই মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে। পূর্বের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, আর্সেনিক মায়ের গর্ভফুল ভেদ করে গর্ভের সন্তানকে আক্রান্ত করতে পারে এবং পরে আর্সেনিক শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্নায়ুর বিকাশ ব্যাহত করে। এর ফলে শিশুর স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে পানিতে ডুবে মরার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ প্রকাশিত ২০১০ সালের এক জরিপ প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের ১২ শতাংশের বেশি পরিবারের পানীয় জলে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অধিক আর্সেনিক রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী ২০১২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আর্সেনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে। ইতিপূর্বে এনজিও ফোরাম ফর ড্রিঙ্কিং ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুসারে দেশের ২১৭টি উপজেলার প্রায় ৭ কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহরাঞ্চলে আর্সেনিক আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় সাধারণত আর্সেনিকের প্রকোপ অন্যান্য এলাকার চেয়ে কম হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে ঘটছে এর উল্টো। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। ১৯৯৩ সালে দেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে শনাক্ত হওয়ার পর আর্সেনিক সমস্যার তীব্রতা নিরূপণে কাজ চলছে। তাতে আর্সেনিকের ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে। আর্সেনিক মিশ্রিত পানি ব্যবহারে শুধু স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াও দেশে খাবার পানিসহ গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার-উপযোগী পানিরও তীব্র সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং উদাসীনতার কারণে পানি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে ব্যবহার উপযোগিতা। বাংলাদেশের মোট পানির ৮৬ ভাগই ব্যবহূত হয় কৃষিকাজে। আর মাত্র ৪ ভাগ পানি মানুষ ব্যবহার করে খাবার ও গৃহস্থালি কাজে। ভূপৃষ্ঠের পানির মারাত্মক দূষণের কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষই আজ নলকূপের পানির ওপর নির্ভরশীল। নলকূপ বা টিউবওয়েলই হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির প্রধান উত্স। আর বেশির ভাগ নলকূপের পানিতে রয়েছে মারাত্মক আর্সেনিক নামক বিষ। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় আর্সেসিক ও লৌহের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে হাজার হাজার গভীর নলকূপেও পানি ওঠে না। বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিলসহ সমুদ্রের পানি দূষিত হয়ে বর্তমানে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এর কারণ হিসেবে নদ-নদীতে অনিয়ন্ত্রিত গৃহস্থালি বর্জ্য অপসারণ, কলকারখানার অশোধিত রাসায়নিক তরল বর্জ্য মিশ্রণ, জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপ্রতিরোধ্য ব্যবহারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠের দূষিত পানি ধীরে ধীরে ভূগর্ভে প্রবেশ করে কালক্রমে ভূগর্ভস্থ বিশুদ্ধ পানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে ভূ-অভ্যন্তরে আর্সেনিক নামক মারাত্মক পদার্থের প্রবেশ ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের ক্ষেত্রে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ভূতাত্ত্বিক গঠনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, জলাবদ্ধতা ও বদ্ধ জলাশয়ের কারণে ভূপৃষ্ঠের উপরিতলে আর্সেনিক জমাটবদ্ধ হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করেন। আর্সেনিক অ্যাসিড সম্পূর্ণরূপে পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। ফলে পানীয় জল হিসেবে ভূগর্ভস্থ নলকূপের পানিও আজ অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য নয়। বিগত দিনে আর্সেনিক মিশ্রিত নলকূপের পানি পান করা থেকে জনগণকে বিরত থাকার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব কূপকে চিহ্নিত করে দিলেও কাছাকাছি আর্সেনিকমুক্ত পানি না পেয়ে জনগণ বিষাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে। পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার প্রক্রিয়াকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব না হওয়ার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ আজও জীবনঝুঁকি নিয়ে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে রোগভোগের শিকার হচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ আর্সেনিক মিশ্রিত পানির নির্মম শিকার। নিরুপায় হয়ে এসব অঞ্চলের মানুষ আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পান করে নানারূপ রোগব্যাধির শিকার হচ্ছে। আর্সেনিক নামক বিষাক্ত পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে হাত ও পায়ের ত্বকের নানা রোগ সৃষ্টি করে। এছাড়া আর্সেনিক মানুষের যকৃত্, ফুসফুস, কিডনি, পরিপাক অন্ত্র এবং মূত্রথলির ক্ষতিসাধন করে। এমনকি দীর্ঘদিন আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পান করলে তার পরিণতি মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে। আর্সেনিক একটি মারাত্মক বিষাক্ত পদার্থ, যা নানা উেসর মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানিকে সহজে দূষিত করতে পারে। আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ০.০৫ মি.গ্রা/লি. হলেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে এর মাত্রা বেশি থাকে। ভূপৃষ্ঠের পানিকে ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করা গেলেও পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজ নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে টি-ব্যাগের মতো বিশেষ ধরনের প্যাক পানিতে ভিজিয়ে পানি আর্সেনিকমুক্ত করে ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এমনকি ফিটকারি বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে আর্সেনিক দূরীকরণের প্রক্রিয়া প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে বাজারে তৈরি ফিল্টার ব্যবহার করে পানির আর্সেনিক দূর করার প্রচলিত ধারণা কতটা কার্যকর তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পানিকে সম্পূর্ণ বা আংশিক আর্সেনিকমুক্ত করতে সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যদিও এসব পদ্ধতি ঘরে ঘরে মানুষের প্রয়োগ করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এসব পদ্ধতির মধ্যে কিছু সহজ পন্থা মানুষের জানা থাকলে ঘরে বসে মানুষ পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করে ব্যবহার করতে পারেন। পানি আর্সেনিকমুক্ত করার পদ্ধতিগুলো হচ্ছে কো-প্রেসিপিটেশন ও অ্যাডজরপশন, লাইম ট্রিটমেন্ট, অ্যাডজরপশন : সপটিভ মেডিয়া, আয়ন এক্সচেঞ্জ রেসিন, মেমব্রেন কৌশল এবং মাইক্রোবায়াল। এর মধ্যে দুয়েকটি পদ্ধতি গ্রহণ করে বাড়িতে বসে পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করা সম্ভব। দীর্ঘকাল ধরে আর্সেনিক সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও কাজ করলেও বর্তমানে তা স্থবির হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক সাহায্য কমে যাওয়া এ পরিস্থিতির কারণ হতে পারে। কিন্তু দেশের একটি জনগোষ্ঠীকে আর্সেনিকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া জরুরি। আর্সেনিক বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে মূলত কাজ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। আর স্থানীয় সিভিল সার্জন কার্যালয় আর্সেনিক আক্রান্তদের চিকিত্সাসেবা প্রদান ও সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। অথচ জানা গেছে, দেশের সর্বাধিক আর্সেনিক আক্রান্ত বিভাগ চট্টগ্রামের জন্য কোনো ধরনের গবেষণা বা প্রকল্প অদ্যাবধি গৃহীত হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের লক্ষ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং বেসরকারি সংস্থাসমূহের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। পানি থেকে আর্সেনিক দূরীকরণের উপকরণ সরবরাহ করা আবশ্যক। পাশাপাশি আর্সেনিকযুক্ত পানির নলকূপগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এসব কূপের পানি পান করা থেকে জনগণকে বিরত থাকার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো অত্যাবশ্যক। আর্সেনিক আক্রান্তদের চিকিত্সা সহায়তা প্রদান করাও জরুরি। পানির অপর নাম জীবন হলেও বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানিই মানুষের জীবন বাঁচিয়ে রাখে। দূষিত পানি মানুষের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কাজেই ভূগর্ভস্থ পানি যাতে আর্সেনিক দ্বারা দূষিত হতে না পারে তার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই হচ্ছে মানুষকে স্থায়ীভাবে আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহের উত্তম পথ এবং আগামী দিনে ভূপৃষ্ঠের নিরাপদ পানি সরবরাহ করা। তা হতে পারে বৃষ্টির পানিকে ধরে রেখে রিজার্ভারে সংরক্ষণ করা। বাংলাদেশের যেসব এলাকায় পানির আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেশি সেসব এলাকায় সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে রিজার্ভ ট্যাঙ্ক যেকোনো উপায়ে আর্সেনিকমুক্ত করে সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে জনগণকে সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর্সেনিক আক্রান্ত মায়ের সঙ্গে কম বয়সী শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও সবার জন্য আর্সেনিক ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থমুক্ত নিরাপদ পানির ব্যবহার সুনিশ্চিত করা জরুরি। যত শিগগির সম্ভব আর্সেনিক ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায় ততই মঙ্গল। 

খবরটি সংগ্রহ করেনঃ- আই-নিউজ২৪.কম
এই খবরটি মোট ( 8068 ) বার পড়া হয়েছে।
add

Share This With Your Friends