বাংলাদেশ | মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩, ২০২৪ | ১৯ অগ্রহায়ণ,১৪৩১

সম্পাদকীয়

27-06-2016 06:38:00 AM

গল্প বানানোর সাংবাদিকতা ছাড়ুন

newsImg

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা কোনো কোনো গণমাধ্যমের বেলায় গল্পবাদিকতায় পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমই এখন দায়িত্বশীল সূত্রের বরাত দিয়ে গল্প বানিয়ে সংবাদ ছাপাচ্ছে নতুবা  দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের বানানো গল্পকে সংবাদ হিসেবে প্রচার করছে।

শনিবার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা নিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদের ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। শীর্ষস্থানীয় নামধারী একটি অনলাইন পত্রিকা সংবাদ প্রচার করেছে স্ত্রী হত্যার সাথে এসপি বাবুল আক্তার নিজেই জড়িত। অল্প সময়ের ব্যবধানে এ সংক্রান্ত পরপর কয়েকটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে অনলাইন পত্রিকাটি।

অনলাইনটির বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে বেশকিছু কপি-পেস্ট অনলাইন পত্রিকা এবং প্রিন্ট পত্রিকার অনলাইন সংস্করণও। দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে খবর প্রচার করা হয় বাবুল আক্তার নিজেই স্ত্রী হত্যার ছক কেটেছিলেন। বাবুল আক্তারের স্ত্রীর পরকীয়ার আভাস দেওয়া হয় আরেকটি খবরে। একটি খবরে স্পষ্ট করেই বলা হয় চট্রগ্রামের এক ব্যবসায়ীর সাথে পরকীয়া ছিল মিতুর। স্ত্রীর পরকীয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াই নাকি তাকে হত্যা করতে বাধ্য হন বাবুল। বলা হয় চাচাত ভাই সাইফুলকে নিয়ে স্ত্রী হত্যার ছক  কেটেছিলেন বাবুল আক্তার।

এসব সংবাদ সত্যি হয়ে থাকলে বাবুল আক্তারকে পুলিশ আটক করার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম বাবুল আক্তারকে ছেড়ে দিয়েছে ডিবি। এই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর অনলাইন পত্রিকাটিও তাদের বিশেষ প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে নিয়েছে কিংবা শিরোনাম পরিবর্তন করে ভেতরের খবর পাল্টে দিয়েছে (অনলাইন পত্রিকার জন্য একাজটি করা খুবই সহজ)। এতে আপাতত আমরা এতটুকু বুঝতে পারি যে, গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রের বরাত যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার আসলে কোনো ভিত্তি ছিল না।

বাবুল আক্তারকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার পর বাবুল আক্তার টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হওয়ায় তাকে নিয়ে করা অনলাইন পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদনগুলো খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একই সাথে যখন প্রমাণিত হয় এই খবরগুলো ভিত্তিহীন তখনই শুরু হয় গল্প তৈরির বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা।

অথচ গল্প তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সবগুলো বড় বড় ঘটনায়। এক্ষেত্রে হয় পুলিশ গল্প বানিয়ে দিয়েছে আর সেটা কোন বাছ-বিচার করা ছাড়াই প্রকাশ করেছে সংবাদ মাধ্যমগুলো, নতুবা ‘দায়িত্বশীল সূত্রে’র বরাত দিয়ে নিজেরাই গল্প বানিয়ে নিয়েছে । অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মতো করে শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে পুলিশের বানানো গল্প।  এই রেওয়াজটা চলে আসছে বহুদিন ধরে।

ওয়ান ইলেভেনের পরবর্তী সময়ে দেশের অধিকাংশ বহুলপ্রচারিত পত্রিকায়ই এরকম গল্প সংবাদ হিসেবে ছাপা হয়েছিল। যদিও এজন্য সমালোচনার কামানটা শুধুমাত্র ডেইলি স্টার সম্পাদকের দিকেই দাগা হয়েছে।

গুরুত্ব বুঝাতে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। মূলত কখনো কখনো গণমাধ্যম রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়েও  বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

শুধু জনগণের কাছে খবর পৌঁছানোই নয়, বরং যে কোনো দেশে গনতন্ত্রের জন্য স্থান তৈরি করে দিতে কিংবা রাষ্ট্রকে স্বচ্ছতা আনতে বাধ্য করতে, জনগণের চেতনাকে ধরতে কিংবা জনগণের চেতনাকে জাগ্রত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয় মিডিয়াকে। সে মিডিয়া যদি গল্প তৈরি করে, অন্যের তৈরি করা গল্পকে সংবাদ হিসেবে প্রচার করে, বিশেষ বিশেষ ঘটনায় নীরব থাকে, হিডেন অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে তাহলে সে সমাজে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ-দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি হয়। আমরা মনে হয় বর্তমানে সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যদিয়েই যাচ্ছি।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকতার বদলে গল্পবাদিকতা এখন সাধারণ জনগণও বুঝতে শুরু করেছেন। একই সাথে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে বাংলাদেশের সমগ্র গণমাধ্যম। এইভাবে চলতে থাকলে দেশ-জাতি এমনকি সাংবাদিকতা পেশাটিও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে ভবিষ্যতে। এ পরিস্থিতি থেকে আশু উত্তরণ অপরিহার্য।

তাই সর্বশেষ যে আবেদনটি রাখতে চাই- সাংবাদিকতার মত মহান পেশাটিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে এবং দেশ ও জাতিকে সত্য, সুন্দর ও উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে দয়া করে সাংবাদিকরা গল্পবাদিকতা ছাড়ুন আর গল্পবাদিকরা সাংবাদিকতা ছাড়ুন।

লেখক : শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

খবরটি সংগ্রহ করেনঃ- আই-নিউজ২৪.কম
এই খবরটি মোট ( 5336 ) বার পড়া হয়েছে।
add

Share This With Your Friends