27-03-2016 09:33:42 PM
দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের আলোচিত বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, কারসাজি ও চুরির ঘটনা নিয়ে পাতাজুড়ে বিশেষ আয়োজন|গত দেড় দশকে ব্যাংকিং খাতে ছয়টি বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। ভুয়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানীয় ঋণপত্র খুলে যেমন টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে; আবার কাগুজে কোম্পানির নামেও ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের জালিয়াতি করতে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে যোগসাজশ ছিল। রাজনৈতিক প্রভাবেই ব্যাংক খাতে এসব কেলেঙ্কারি হয়েছে।ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারি হয়েছে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে। এ শাখা থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে হল-মার্ক গ্রুপের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। গত ১৫ বছরে কেবল ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে জালিয়াতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় অনেকগুলো ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এর বাইরে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি অবলোকন করা হয়েছে আরও প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই আর ফেরত পাওয়া যাবে না।
ছোট ব্যবসায়ীর বিরাট চুরি
ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারিটি ঘটেছে ২০১২ সালে। তৈরি পোশাক খাতের হল-মার্ক নামের একটি স্বল্প পরিচিত গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে রপ্তানির ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নানা কারসাজি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়। এর মধ্যে হল-মার্ক গ্রুপ ও এর ভুয়া সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। হল-মার্কের অস্তিত্বহীন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে স্থানীয় এলসি (ঋণপত্র) খুলে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া ওই সময়ে আরও কয়েকটি কোম্পানি আরও ১ হাজার কোটি টাকা এভাবে জালিয়াতি করে ওই ব্যাংকের শাখা থেকে তুলে নেয়। পরে সেগুলো হল-মার্কের মালিকের স্বজনদের প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে।
এ ঘটনার পর ওই বছরের অক্টোবর মাসে ঘটনার নায়ক হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তের ভিত্তিতে মামলা করে। সেই মামলার রায় এখনো হয়নি। তবে জামিন পেয়ে জেল থেকে বের হয়েছেন জেসমিন ইসলাম।
এ ছাড়া ২০১২ সালেই অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির তৎকালীন সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে প্রতিবেদন জমাও দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন আর প্রকাশ করা হয়নি।
কাগুজে কোম্পানির নামে আত্মসাৎ
টেরিটাওয়েল (তোয়ালেজাতীয় পণ্য) উৎপাদক বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের পাঁচটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ২০১১ ও ২০১২ সালে এ ঘটনা ঘটে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এ চিত্র উঠে আসে।
ভুয়া রপ্তানি দেখানো, বিদেশে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তার মাধ্যমে অতিমূল্যায়ন করে বাংলাদেশ থেকে আমদানি এবং এর মাধ্যমে রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা তুলে নেয় বিসমিল্লাহ গ্রুপ। এর পাশাপাশি হল-মার্কের মতোই নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের খোলা স্থানীয় এলসি (ঋণপত্র) দিয়ে আরেক (এটাও নিজস্ব) প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি নিয়ে বিল তৈরি করে (অ্যাকোমুডেশন বিল) তা ব্যাংকে জমার মাধ্যমে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। যেসব ব্যাংক থেকে অর্থ নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ৩৯২ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংকে ৩০৬ কোটি, যমুনা ব্যাংকে ১৬ কোটি, শাহজালাল ব্যাংকে ১৪৮ কোটি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে ৬২ কোটি টাকা।
এ ঘটনায় এসব ব্যাংকের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হন। আর বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী ও চেয়ারম্যান নওরীন হাসিব তখন দেশ থেকে পালিয়ে যান।
ভালো ব্যাংক খারাপ হলো
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক একসময় ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমান সরকার আসার পর ব্যাংকটি খারাপ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। আইন ও বিধিমালার তোয়াক্কা না করেই হাজার হাজার কোটি টাকা ইচ্ছামতো ঋণ দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটির বিরোধিতা সত্ত্বেও পর্ষদ অনুমোদন দিয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরের মাত্র ১১টি পর্ষদ সভায়ই ৩ হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এভাবে অনিয়ম করে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মতো ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে তা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শেখ আবদুল হাই (বাচ্চু) নিজের একক প্রভাবে এসব ঋণ দিতে বাধ্য করেছেন। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, অপ্রতুল জামানতের বিপরীতে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে মতিঝিল, শান্তিনগর ও গুলশান শাখা থেকেই সিংহভাগ ঋণ দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই ব্যাংকের এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। চাপের মুখে চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু পদত্যাগ করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে মামলা করেছে। মামলায় শেখ আবদুল হাইয়ের নাম নেই। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
উদ্যোক্তারাই নিয়েছে ৬০০ কোটি টাকা
ব্যাংকের উদ্যোক্তারাই নানা ফন্দিফিকির করে টাকা চুরি করে নিয়ে গেছেন। ২০০৫ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে এ ব্যাংকের উদ্যোক্তারা নানা অনিয়ম করে ৫৯৬ কোটি টাকা তুলে নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এ অনিয়ম ধরা পড়লে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক বসানো হয়। অভিযুক্তদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন ব্যাংকটির মালিকানায় ছিল ওরিয়ন গ্রুপ। পরে ব্যাংকটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাইরের একটি শিল্পগোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করা হয়। এখন ব্যাংকটির নাম আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
টাকা নিয়ে উধাও
মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ওমপ্রকাশ আগরওয়াল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পালিয়ে যান। ২০০২ সালে ঘটনাটি ঘটে। মার্কেন্টাইল, ঢাকা, আইএফআইসি, এনসিসি ও ওয়ান ব্যাংক থেকে এ টাকা ঋণ নেন তিন। ওমপ্রকাশের প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তার নামে এ ঋণ নেওয়া হয়েছিল। পরে ওই দুই কর্মকর্তা রহস্যজনকভাবে নিহত হন। গত দেড় দশকে ওমপ্রকাশ আগরওয়াল বাংলাদেশে আসেননি। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পাঁচটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চাকরি হারান।
রপ্তানির নামে আত্মসাৎ
২০০৫ সালে চট্টগ্রামের অখ্যাত ব্যবসায়ী নুরুন্নবী ভুয়া রপ্তানির নামে ৬৯৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ঘটনাটি জানাজানি হয় ২০০৭ সালে। এম. নুরুন্নবী বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক শাখা থেকে স্থানীয় ঋণপত্রের (এলসি) স্বীকৃতি (অ্যাকসেপট্যান্স) দিয়ে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঠানো তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দুদক মামলা করে।