27-03-2016 09:32:00 PM
ব্যাংক খাতের বাইরে দেশের অর্থনীতির আরেকটি বড় ক্ষেত্র শেয়ারবাজার। সেই শেয়ারবাজারেও ১৫ বছরের ব্যবধানে বড় দুটি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। শেয়ারবাজার প্রসঙ্গ এলেই ঘুরেফিরে আসে এই দুটি কেলেঙ্কারির কথা। একটি ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারি, অপরটি ২০১০ সালের কেলেঙ্কারি হিসেবে বহুল আলোচিত। আর এই দুটি কেলেঙ্কারির ঘটনার সময়ই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার।শেয়ারবাজারের আলোচিত এই দুই কেলেঙ্কারির পর মহা-সাড়ম্বরে সরকারের উদ্যোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়। অভিযুক্ত করা হয় অনেককে। এমনকি দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় মোট ১৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে ’৯৬-এর কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১৫টি আর ২০১০ সালের ঘটনায় দুটি মামলা।
১৭টি মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে কেবল ’৯৬ সালের চিক টেক্সটাইল মামলায়। আর বিচার চলমান আছে অপর একটি মামলার। বাকি ১৫টি মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এসব মামলার বিচারিক কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাজা না হওয়া ও বাজারে তার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয়ে সবার যে প্রত্যাশা ছিল, সেটি পূরণ হয়নি। ফলে অপরাধীদের মধ্যে কোনো ধরনের ভয়ভীতির সঞ্চার করা সম্ভব হয়নি। উল্টো তাদের কাছে বার্তা গেছে, অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও একধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজারের মামলা নিষ্পত্তিতে গত বছরের জুনে কার্যক্রম শুরু করেন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর চারটি মামলা বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হয়ে আসে। সেগুলো হলো ’৯৬ সালের চিক টেক্সটাইল, প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ ও চিটাগাং সিমেন্ট এবং ২০১০ সালের সৈয়দ সিরাজউদ্দৌলা, তাঁর স্ত্রী রাশেদা আক্তার মায়া এবং মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মামলা। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে এই মামলা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে আসার পর চারটি মামলারই বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। তার মধ্যে গত বছরের আগস্টে চিক টেক্সটাইলের মামলায় অভিযুক্ত দুই আসামিকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশাপাশি আর্থিক জরিমানাও করা হয়। তবে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামি দেশের বাইরে থাকায় সাজা ভোগ করতে হয়নি।
১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির চিটাগাং সিমেন্টের মামলাটি ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার প্রাক্কালে এসে উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে যায়। একই বছরের কেলেঙ্কারির প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
আর ট্রাইব্যুনালের আসা ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির একমাত্র মামলাটিরও মাঝপথে এসে উচ্চ আদালতের আদেশে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
এর ফলে দেখা যাচ্ছে, শেয়ারবাজারের আলোচিত দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সিংহভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ১৫টি মামলা হয়। দীর্ঘদিন ধরে সেসব মামলার বিচার কার্যক্রম থেমে থাকায় তদন্ত কমিটির সদস্যরাও বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। গত বছর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য নিজেদের শারীরিক অক্ষমতার বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরেন।
১৯৯৬ সালের মামলাগুলোতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বেক্সিমকো গ্রুপের সালমান এফ রহমান ও আসিফ এফ রহমান, অলিম্পিক গ্রুপের মোহাম্মদ ভাই ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই, টি কে গ্রুপের আবু তৈয়ব, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক রকিবুর রহমান, ডিএসইর সাবেক পরিচালক মুসতাক আহমেদ সাদেক প্রমুখ। এ ছাড়া ’৯৬ সালের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। স্থায়ীভাবে দেশের বাইরে চলে গেছেন বেশ কয়েকজন।
এদিকে ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে অনিয়ম ও অপরাধের বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরলেও মামলা হয়েছে মাত্র দুটি। বাকি ঘটনাগুলোর বেশির ভাগেরই কোনো সুরাহা হয়নি। অথচ ওই সব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিএসইসিকে। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোর বিষয়ে বিএসইসি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বাজার বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকের মতে, অতীতের অনিয়মের কোনো বিচার না হওয়ায় বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। তাই শেয়ারবাজার দীর্ঘকালীন এক মন্দাবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। গত জানুয়ারি মাসে শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে ব্যর্থতার দায়ে বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যানের পদে পরিবর্তনের দাবি করেছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ২৫ জানুয়ারি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বিএসইসির যে ধরনের শক্তিশালী ও সৎ অবস্থান তৈরি করা দরকার ছিল, তা তারা করতে পারেনি।
ওই সাক্ষাৎকারে কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির প্রসঙ্গে ইব্রাহিম খালেদ বলেছিলেন, অপরাধীদের শাস্তির বিষয়ে বিএসইসি অত্যন্ত দুর্বল। অভিযুক্ত বিএনপিদলীয় নেতা মোসাদ্দেক আলীকে জরিমানা করা হলেও তার চেয়ে বেশি অপরাধে অপরাধী সরকারদলীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।