03-04-2018 11:02:35 AM
নানা উদ্যোগের কারণে এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। গত কয়েক বছর ধরে প্রশ্ন ফাঁসের ধারাবাহিকতা চলে আসলেও গতকালের পরীক্ষা হয়েছে প্রশ্ন ফাঁস ছাড়া। লটারিতে সেট নির্ধারণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এবার প্রশ্নফাঁস ঠেকানোর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই গতকালের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এজন্য অভিভাবকদের ধন্যবাদ জানাবো। তারাই সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
আর মানুষের পক্ষে যত পদক্ষেপ নেয়ার দরকার সবই আমরা নিয়েছি। এরপরও প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যা যুক্ত হচ্ছে। এসব সমস্যা মোকাবিলায়ও আমরা অগ্রিম কিছু পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছি। আশা করি এবার নকলমুক্ত বা প্রশ্নফাঁসমুক্ত একটি পরীক্ষা জাতিকে উপহার দিতে পারবো। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্যান্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর। কেউ যদি প্রশ্ন ফাঁসের চেষ্টা করে তাহলে সে পাকড়াও হয়ে যাবে এবং কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
এদিকে প্রশ্নফাঁস ছাড়াই পরীক্ষা শেষ হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট। গতকাল সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, প্রশ্নফাঁসসহ অসদুপায় অবলম্বনের বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিরোধ, নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান নিশ্চিত করতে প্রচলিত কারিকুলাম ও পাঠদান বর্তমান পাবলিক পরীক্ষা কতটা উপযোগী ও শিক্ষার্থীবান্ধব তা নির্ধারণ করতে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রথম বারের মতো এবার প্রশ্নের চারটি সেট কেন্দ্রে পাঠানো হয়। প্রত্যেকটি সেটে ডাবল প্যাকেট করে মোড়ানো ছিল। প্রথম কাভারে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো ছিল। আর ভেতরে বা দ্বিতীয় সেটটি ছিল বিশেষ সিকিউরিটি দিয়ে বিশেষ কায়দার মোড়ানো। যে কেউ এ প্যাকেট খুললে দ্বিতীয়বার আর হুবহুভাবে লাগাতে পারবে না। বিশেষ সিকিউরিটির কারণে প্যাকেট খোলা ব্যক্তিকে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া রাখা হয়েছে। এবার প্যাকেট কেন্দ্রে পৌঁছানো ও খোলা পর্যন্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমান কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন। কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছানোর পর সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা)কে কোন সেটে পরীক্ষা হবে তা এসএমএস করে জানিয়ে দেয়া হয় বোর্ড থেকে। এরপর স্থানীয় প্রশাসন নির্ধারিত সেট খুলে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা শুরু করে। এছাড়াও প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে গত ১৫ দিন আগে থেকেই পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার নজরদারি ও সরজমিন টহল চালিয়ে আসছেন। প্রশ্নফাঁসকারী চক্রকে ধরতে পুলিশ, সিআইডি ও র্যাব কর্মকর্তারা নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী প্রশ্নপত্র ফাঁসের টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। নির্দিষ্ট কিছু মোবাইল ফোন নম্বরে এসব টাকা পাঠানো হয়। সন্দেহজনকভাবে অবৈধ লেনদেন করলে সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থী বা তার স্বজন ও টাকা গ্রহণকারীকে সহজেই চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নজরদারির মধ্যে নেয়া হয়েছে দেশের মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। বিজি প্রেস থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সবখানেই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি। এবারের প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বিশেষ ১৭টি টিম গঠন করা হয়েছে। পুলিশের কন্ট্রোল রুম ৯৯৯ সার্বক্ষণিক এ ধরনের অভিযোগ তদারকি করছে। কর্মকর্তারা জানান, এসএসসির মতো এইচএসসিতেও পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষার হলে বসতে হচ্ছে। কেউ দেরি করলে পরীক্ষার্থীর নাম, রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর নথিভুক্ত করে রাখা হচ্ছে। সব সেট প্রশ্ন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্রের সেট নির্ধারণ করা হচ্ছে পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে লটারির মাধ্যমে। এসএমএস-এর মাধ্যমে সেই তথ্য জানানো হচ্ছে কেন্দ্র সচিবকে। তারপর সিকিউরিটি টেপ ও সিলগালা ভেঙে খোলা হচ্ছে প্রশ্নের প্যাকেট। ট্রেজারি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশ্ন নিতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছাড়া অন্য সবার ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে আগের মতোই। পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রের ২০০ গজের মধ্যে পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষা সংশ্লিষ্টরা বাদে অন্যদের ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ করা হয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের বিজ্ঞাপনের বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং তা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমরা বিটিআরসিকে সঙ্গে সঙ্গে তথ্যগুলো জানিয়ে দিয়েছি। আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশেষভাবে কাজ করছে এগুলো নিয়ে, আমরাও সব জানি না, জানার দরকারও নেই। এ ধরনের প্রশ্ন ফাঁসের কাজে যারা নিয়োজিত আছেন তাদের ধরার জন্য সকলের সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা দরকার।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক বলেন, সবার সহযোগিতায় কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই প্রথম দিনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে আমরা যেসব উদ্যোগ নিয়েছি আগামী পরীক্ষাগুলোতেও একই ভাবে একই উদ্যমে কাজ চলবে।
এদিকে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্র সরজমিন পরিদর্শন করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে প্রশ্ন ফাঁসের উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়। ফার্মগেটে বিজ্ঞান কলেজে বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ কলেজের পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টিকে কোনো পাত্তা দেই না। যতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছি পরীক্ষা ভালো হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর বিজ্ঞান কলেজের গোটা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পরীক্ষার হলে ঢুকার আগ পর্যন্ত অনেক পরীক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন ছিল। তবে সেটাতে তারা শর্ট সাজেশন্স দেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। প্রশ্নফাঁস হয়নি এ খবর তাদের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করে। রাজধানীর সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের পরীক্ষার্থী সামিয়া উম্মে হাবিবা পরীক্ষা শেষে বলেন, সিকিউ পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে। আগের বছরের এমসিকিউ প্রশ্নের চেয়ে একটু কঠিন হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রথম দিনের পরীক্ষা সুন্দর ভাবেই দিয়েছি। সে আরো বলেন, লেখাপড়া করেই সব সময়ে পরীক্ষায় অংশ নেই। প্রশ্নের পেছনে কখনই ছুটি না। প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিলে নৈতিক ভাবে তারা দুর্বল থাকে।
প্রথম দিনে এইচএসসিতে অনুপস্থিত ১৩ হাজার
এদিকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রথম দিনে ১৩ হাজার ৭১৮ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন এবং সহযোগিতার অভিযোগে প্রথম দিনে সাতজন পরিদর্শকসহ ৮৯ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মু. জিয়াউর হক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। গতকাল এইচএসসিতে বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম পত্র, সহজ বাংলা প্রথম পত্র, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রথম পত্র এবং বাংলা (আবশ্যিক) প্রথম পত্র (ডিআইবিএস) এবং আলিমে কুরআন মাজিদ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন ঢাকা বোর্ডে দুই হাজার ৪৮৯ জন, রাজশাহীতে এক হাজার ২৫৯ জন, কুমিল্লায় এক হাজার ১৯ জন, যশোরে এক হাজার ৬১ জন, চট্টগ্রামে ৯৯৮ জন, সিলেটে ৭০৬ জন, বরিশালে ৬৫১ জন এবং দিনাজপুর বোর্ডে এক হাজার ৬৩ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া মাদরাসা বোর্ডে ২ হাজার ৪৮৬ জন এবং কারিগরি বোর্ডে ১ হাজার ৯৮৯ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। অন্যদিকে নকলের দায়ে কারিগরি বোর্ডে ৩২ জন, মাদরাসা বোর্ডে ৪০ জন এবং ঢাকা বোর্ডে সাতজন, বরিশালে ৬ জন, দিনাজপুরে ২ জন, যশোর ও সিলেটে একজন করে পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট বোর্ডে চারজন ও কারিগরি বোর্ডের ৩জন পরিদর্শককেও বহিষ্কার করা হয়েছে। বাংলাদেশের দুই হাজার ৫৩২টি কেন্দ্রে গতকাল থেকে একযোগে শুরু হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা; যাতে অংশ নিচ্ছেন ১১ লাখের বেশি শিক্ষার্থী।
আই-নিউজ২৪.কম:নিলুফার ইয়াসমিন