07-02-2018 04:54:03 PM
সে আমলে ছাত্রাবস্থায় আমরা যারা হরদম হারমোনিয়াম বাজাতাম আর তাসের ঘরে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যনাটক মায়ার খেলা, শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা কিংবা চণ্ডালিকাকে কে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, তাদের কেউ কেউ এখন ডাকসাইটে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব, কেউ কেউ উপ-প্রতি-পূর্ণ বা অপূর্ণ মন্ত্রী—এসবই তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। একবার হারমোনিয়াম বাজালে সারা জীবন সেটা বাজাতে হবে, এমন কোনো প্রথা নেই। তবে ছাত্রজীবনের একটা তাছির বা প্রভাব জীবনে থেকেই যায়—‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের এখন চোর অনুসন্ধানপর্ব চলছে। নগর কোটাল থেকে শুরু করে মন্ত্রী, যন্ত্রী, উস্তাদ-সাগরেদ, পিএস, এপিএস— সবার একই কথা, চোর ধরতে হবে যেকোনো মূল্যে; যেন সবাই একই সুরে গাইছে:
‘চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে,/ চোর চাই যে করেই হোক।/ হোক-না সে যেই-কোনো লোক, চোর চাই। নহিলে মোদের যাবে মান!’
মান রক্ষার এই অনুসন্ধানের মূল্য চড়ানো হয়েছে পাঁচ লাখ। এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে এই পুরস্কার মিলবে। পাঁচ কোটি টাকা বা রুপি অথবা ডলার দিয়ে যারা বড় বড় কোটাল কি কোটালপতি কেনার বা বেচার তাকত রাখেন, তাদের টিকির সন্ধান কি পাঁচ লাখে মিলবে? আদতে এসব চোর ধরতে লালনের তরিকা ছাড়া পথ নেই—ঠাকুরের অনেক আগে লালন চোর ধরার সবচেয়ে কার্যকর তরিকা বাতলে ছিলেন। তাঁর মতে, চোর ধরতে হলে হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পাততে হবে আর গারদটা খাঁটি করতে হবে—গারদে গলদ থাকলে কোনা-কানচিতে বা পাতালে বা আসমানে থাকা চোরের নাগাল পাওয়া যাবে না; কোটি টাকার এনাম দিলেও হবে না —এরা সামান্য চোর নন!!! থাকে পাতালে কিন্তু মনে হয় আকাশে ভাসছে! এমন জটিল চোরের সন্ধান মেলা চাট্টিখানি কথা নয়, ঘরে অথবা ঘোরের মধ্যে ফাঁদ না পাতলে ধরা মুশকিল!!! লালন বলেছেন,
ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।
সেকি সামান্য চোরা / ধরবি কোনা কানচিতে।।
পাতালে চোরের বহর/ দেখায় আসমানের উপর।
…চোর ধরে রাখবি যদি/ হৃদ-গারদ কর গে খাঁটি।
লালন কয় খুঁটিনাটি/ থাকতে কি চোর দেয় ছুঁতে।।
ফাঁস নিয়ে সারা দেশ যখন হাঁসফাঁস করছে, তখন এক মারাত্মক খবর এল তারে তারে, ছবিতে খবরে, টিভির পর্দায় স্ক্রলে—আমাদের কোনো একটা জিলা স্কুলের বাংলার শিক্ষক হাতেনাতে ধরা পড়েছেন, স্কুলে বসেই (পরীক্ষার হলে) তিনি প্রশ্নপত্রের সমাধান তৈরি করছিলেন। পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সদাশয় ম্যাজিস্ট্রেট ধরেছেন তাঁকে; কথিত শিক্ষককে গ্রেপ্তারের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাঁকে সাত দিনের বিনাশ্রম জেল দেওয়া হয়েছে; আমাদের জিলা স্কুলে বাংলা ব্যাকরণ (২য় পত্র) পড়াতেন পণ্ডিত স্যার স্বর্গীয় বিপিন বিহারি পাল; উল্লেখিত খবরটি পাওয়ার পর থেকেই তাঁর চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছে। বাগেরহাটে বাড়ি ছিল তাঁর। সেখানেই ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে খুন হন তিনি, সর্বদা বাংলায় ফেল করা আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ফেল করা ছাত্র হিসেবেই। তিনি আমাদের পড়াশোনা করে পাস করতে শিখিয়েছিলেন, শব্দের বিন্যাস আর ব্যাকরণের মজা চিনতে শিখিয়েছিলেন সেই জায়গায় এ কোন শিক্ষক পাঠদান করেন, পরীক্ষার হলে বসে কোনো রাজনৈতিক নেতার নাতি-পুতির উত্তর লেখার কাজ করেন, শুধু কি তাঁর বিনাশ্রম জেলে এই পাপ ধোয়া যাবে? সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধি কী বলে?
ফাঁস বন্ধের জন্য এখন বহুনির্বাচনী প্রশ্ন বা মাল্টিপল চয়েস অব কশ্চেয়ন (এমসিকিউ) তুলে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে—আগেও উঠেছিল, দুই দফায় ১০ নম্বর করে কমানোয় হয়েছে। এবার এমসিকিউর শূন্যস্থান পূরণ করবে সিকিউ বা সৃজনশীল প্রশ্ন, সৃজনশীল প্রশ্নের সৃজনশীলতা নিয়ে হাসিঠাট্টা কি কম হয়েছে? যে সৃজনশীল শিক্ষক পরীক্ষার হলে বসে তাঁর পছন্দের অথবা রাজনৈতিক নেতাদের বলে দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য উত্তরপত্র তৈরি করেন, তাঁর কাছ থেকে কোন সৃজনশীলতা শিখবে আমাদের ছেলেমেয়েরা?
আসলে যারা নীতিনির্ধারণ করেন, শিক্ষা পরিচালনা করেন, তাঁরা কি দেশ, শিক্ষার মান, উৎকর্ষ, মেধার বিকাশ, বিবেকের লালন—এসব নিয়ে ভাবেন? নাকি সবকিছু ‘সহনীয় মাত্রা’ দিয়ে মাপতে চান? মানুষের যে সহ্যের একটা সীমা আছে, সেটা কি তাঁরা কেবল গুজব হিসেবে ধরে নিয়েছেন না, তাঁদের অনেকের ছেলেমেয়ে নাতি-পুতিরা এ দেশে পড়ে না বলে তাঁরা কোনো কিছুরই ধার ধারেন না!