24-10-2017 03:34:05 PM
ফরিদপুরের শিক্ষার্থী শরণ কুমার রায়। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম তুলেছেন। এ জন্য তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। অনলাইনে ফরম পূরণের সময় কম্পিউটারের দোকানে প্রতিটি ফরমের পেছনে গুনতে হয়েছে ৫০ টাকা করে। শরণের হিসাবমতে, শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতেই তাঁর পাঁচ হাজারের বেশি টাকা খরচ হবে। এর বাইরে আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে তাঁকে।
প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষা এলেই এভাবে অর্থ খরচ করতে হয় শরণের মতো ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের। এর সঙ্গে থাকে ভোগান্তি আর মানসিক চাপ। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেডিকেল কলেজের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) এই পদ্ধতির পক্ষেই সুপারিশ করে আসছে। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইউজিসির অষ্টম পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য উপাচার্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও। তার পরও চালু হচ্ছে না গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর ছুটে বেড়াতে হচ্ছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তাঁদের সঙ্গে ছুটছেন অভিভাবকেরাও। এতে তাঁদের যেমন টাকা ও সময়ের অপচয় হচ্ছে, তেমনি পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে যানজটের কবলে পড়ে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ই’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় কয়েক শ শিক্ষার্থী উপস্থিত হতে পারেননি। অথচ তাঁরা শনিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই রওনা হয়েছিলেন।
জাহিদুল ইসলাম নামের এক পরীক্ষার্থী বলেন, পরীক্ষা দিতে তাঁকে রাজশাহীতে আসতে হয়েছে। কাউন্টারে গিয়ে ট্রেনের টিকিট না পাওয়ায় বাড়তি ১০০ টাকা দিয়ে ৩৪০ টাকার টিকিট ৪৪০ টাকায় কিনতে হয়েছে তাঁকে। পরীক্ষা শেষ করে ফেরার পথে তাঁর খরচ হবে আরও প্রায় ৫০০ টাকা। জাহিদুল আরও বলেন, তাঁর প্রথম পরীক্ষা ২২ তারিখে। শেষ পরীক্ষা ২৬ তারিখে। এ জন্য তাঁকে পাঁচ দিন রাজশাহীতে থাকতে হবে। এতে তাঁর খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে কমপক্ষে আরও এক হাজার টাকা খরচ করতে হবে। হিসাব করে দেখা গেল, তাঁকে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ করতে হবে।
আরও কয়েকজন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো পরীক্ষার্থীর যদি রাজশাহীতে পরিচিত বা থাকার কোনো জায়গা না থাকে, তবে তাঁকে হোটেলে থাকার জন্য অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। আবার অনেক সময় পরীক্ষার্থীর সঙ্গে, বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে এক থেকে তিনজন অভিভাবককে আসতে হয়। এতে খরচের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। ফলে গড়ে একজন শিক্ষার্থীকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।
ঢাকা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা ইমরান হোসেন নামের এক পরীক্ষার্থী জানান, ট্রেনে করে রাজশাহীতে এসে ভোর ছয়টায় রেলস্টেশনে নামেন। স্টেশন থেকে অটোরিকশায় চড়ে তিনি ক্যাম্পাসের বিনোদপুর ফটকে আসেন। অটোরিকশার চালক তাঁর কাছ থেকে ভাড়া নেন ৩০ টাকা। অথচ এই পথের স্বাভাবিক ভাড়া ১০ টাকা।
বিনোদপুর নেমে পাশের হোটেলে খাবার খান ইমরান। দেড় প্লেট ভাত, এক টুকরো মাছ ও ডালের জন্য হোটেলমালিক তাঁর কাছ থেকে নেন ৮০ টাকা, যা অন্য সময়ের দামের চেয়ে দ্বিগুণ। এখানেই শেষ নয়, বিনোদপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলে যেতে রিকশাভাড়া গুনতে হয় ২০ টাকা। অথচ ওই রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা ভাড়া ১০ টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সিরাজুচ সালেকীন বলেন, ভর্তি পরীক্ষা এলেই হলের প্রতিটি কক্ষে পরীক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে থাকেন। কেউ কেউ জায়গা না পেয়ে হলের টিভি রুম, ডাইনিং রুম, মসজিদে পর্যন্ত থাকেন। এই কয় দিন থাকা-খাওয়ার কষ্ট বর্ণনা করার মতো নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘এটা ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এই নির্যাতন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও মহামান্য রাষ্ট্রপতিও গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তার পরও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানছে না। সদ্য কলেজ শেষ করা এই শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন বন্ধে সবাই মিলে একটা পথ খুঁজে বের করা উচিত।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নয়। তবে আমরা গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে। শিক্ষার্থীদের যাতে হয়রানি কম হয়, তার জন্য আমরা চেষ্টা করব।’