12-06-2016 12:30:47 AM
যুগে যুগে মানুষ নিজেকে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে কিংবা কখনো আত্মতৃপ্তি লাভে নিজেকে সাজিয়েছে বিভিন্ন ভাবে। আদি থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সময়ের সাথে তারা নিজেদেরকে সাজিয়েছে নানান কৌশলে রঙে বর্ণে আবরণে এবং আভরণে।
প্রসাধনের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখবো আজ থেকে ২০ হাজার বছর আগের ক্রো-ম্যানোরাই এই প্রসাধন রীতির সর্বজন স্বীকৃত প্রবর্তক। তখন মানুষ ছিলো অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তারা বুঝতো না, জানতো না- আকাশে বজ্রপাত কেন হয়, দাবানল কেন জ্বলে। ঝড়-বৃষ্টি কেন হয়, বন্যা কেন তাদের ঘর-বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়- এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মৃত্যুকে তারা ভীষণ ভয় করতো। মহান প্রভু কি, আল্লাহর মহিমা কি- কিছুই তারা বুঝতো না। ভয়ই ছিলো তাদের নিয়ন্ত্রক। আর এই ভয়কে জয় করার জন্যে তারা নানান রঙে-বর্ণে-অলঙ্কারে নিজেকে সাজিয়ে কল্পিত দেবতাকে সন্তুষ্ট করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভয় থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতো।
মেয়েরা তখন থাকতো মন্ত্র সুরক্ষিত গুহায়। আর পুরুষরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরোতো শিকারে। গায়ে, মুখমন্ডলে রং-এর জাদু মেখে। কালের প্রবাহে সভ্যতা এসে পৌঁছলো ইতিহাসের দরজায়। ততদিনে মানুষ চাষ করতে শিখেছে। জাপানের নব্য প্রস্তর যুগে (খৃস্টপূর্ব ৪৫০০-২০০০) বা নীল নদের উপত্যকায় গড়ে উঠেছে চাষীদের ছোট ছোট বসতি। মিশরে শুরু হয়েছে প্রি-ডাইন্যাস্টি সভ্যতা।
মানুষের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধিও ততদিনে বেড়েছে। ভয় কমেছে দুর্যোগের। তারা নিজেদের ক্ষমতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। ক্রমশ ভয় বিভক্ত হলো দেখা এবং না দেখায়। এখন নীল নদে কবে প্লাবন আসবে, ঘন মেঘ কবে আকাশ ছেয়ে ফেলবে, মানুষ এখন তার গাণিতিক নির্ভুলতায় এর ভবিষ্যদ্বাণী করতে শিখেছে। সুতরাং এসবে তার ভয় নেই। তবু ভয় আছে মৃত্যুকে। একদিন অজ্ঞাত বিপদকে জাদু বলে দূরে রাখতে সে যে প্রসাধনের সূত্রপাত করেছিলো, এখন তা-ই পরিব্যাপ্ত হয়েছে চেনা শত্রুদের বিরুদ্ধেও। হিংস্র পশু এবং তার চেয়ে হিংস্র ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে ভয় পেয়ে নয়- ভয় দেখাতে বা আত্মগোপন করতে তারা মুখ ও সারা শরীর চিত্রিত করা আরম্ভ করলো।
সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে এ সব ছোট ছোট গোষ্ঠীতে গড়ে উঠলো পুরোহিত সম্প্রদায়। সাধারণ মানুষ ভাবতো এরা চির রহস্যময় মৃত্যুর রাজ্যের খবর এনে দেবে। বিপদে-আপদেও জনসাধারণকে পথ দেখাবে, উদ্ধার করবে। এরাই তখন হয়ে উঠলো প্রসাধনের সর্বময় কর্তা। এভাবে প্রসাধন হলো ধর্মের অঙ্গ। প্রসাধনের জটিলতাও বাড়লো। প্রাচীন মিশরীয়রা শরীরে উল্কি অাঁকতো। তারা রেড়ির বীজ থেকে তেল বের করে গায়ে মাখতো সূর্যের আলো থেকে চামড়া বাঁচাতে। এছাড়া তারা মুখ ও চোখের পাতা রাঙাতে শুরু করলো বুনো রেড়ির তেলে সবুজ ম্যালাকাইট (তামার আকর) গুলে।
মিশরের বেনী হাসান নামক স্থানে রয়েছে খুমোটোপের সমাধি। পুরাতাত্ত্বিকেরা এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন এসব প্রসাধনের নিদর্শন। আর সমাধি গাত্রে অাঁকা রয়েছে এমন সব ছবি যা দেখে বোঝা যায় তখনকার দিনে দূর-দূরান্তে প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসা চলতো। মিশরে তখন চোখে কাজল দেয়ার প্রথা চালু হয়। কাজল সীসার এক রকম যৌগ যার ইংরেজী নাম গ্যালেনা। এই কাজল হলো সূর্মার পূর্বসূরী, যা তৈরি অ্যানটিমনি ধাতু থেকে। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ফেরাউনদের আমলে মিশরে চোখের পাতায় বা ভ্রূ অাঁকতে এর ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। ফারাও আখেন-আটেনের রানী নেফার তিতি সূর্মা দেয়া হরিণ চোখের জাদু দিয়ে বিচ্ছিন্ন উত্তর এবং দক্ষিণ নীল উপত্যকাকে সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন এক সাম্রাজ্যের অধীনে। এর ফলে মিশরে কী পরিমাণ সমৃদ্ধি এসেছিলো তা বোঝা যায় নেফার তিতির জামাতা বিখ্যাত ফারাও টুটেন খামেনের সমাধি দেখে। এরও বহু পরে সর্বজনজ্ঞাত মিশর সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার কাজল চোখের দৃষ্টি কী করে পৃথিবীর ইতিহাসটাই পাল্টে দিয়েছিলো তা অনেকেরই অজানা নয়।
তৎকালীন মিশরে প্রসাধনী রং বলতে ছিলো কালো এবং সবুজ রং। রামেসিস ও টলেমিদের সময় মেয়েদের ঠোঁটে এবং কপালে গেরি মাটি বা কারমাইন-এর লাল রং প্রসাধন চালু হয়। তখন সবুজ রং তৈরি হতো ম্যালাকাইট-এর পরিবর্তে সবুজ কপার হাইড্রো সিলিকেট দিয়ে। পিঁপড়ার ডিম বেটে তারা চোখে পেইন্ট করতো। কিন্তু এর ব্যবহার ছিলো অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে।
শরীর রং করার এ ইতিহাস থেকে বোঝা যায় এক সময় হয়তো প্রথাটির ধর্মীয় তাৎপর্য ছিলো গভীর। আবার সূর্যালোক থেকে শরীরের ত্বক রক্ষা এবং শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির কথাও বাদ দেয়া যায় না। হয়তো শেষ পর্যন্ত প্রসাধনে রং ব্যবহারের কারণ হিসেবে মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতিই প্রাধান্য লাভ করেছিলো। এই সূত্রে শরীর রং করার আরেক বিকল্প প্রথাও উল্লেখযোগ্য- যার নাম উল্কি। অন্য বহু প্রসাধনের মতো উল্কি (শরীরকে রং দিয়ে চিত্রিত করা) প্রসাধনেরও উৎপত্তি প্রাচীন মিশরে- খৃস্টপূর্ব ৪ থেকে ২ হাজার বছরের মধ্যে। এরপর প্রথাটি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। আড়াই হাজার বছর আগে ক্রীট হয়ে গ্রীস, পারস্য, আরব এবং আরও প্রায় ৫ শত বছর পরে চীনে। চীন থেকে আইনুরা প্রথাটি জাপানে চালু করে। ক্রমশ জাপানী শিল্পীদের হাতে এটা কারুকলায় উন্নীত হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সুমাত্রা, বোর্নিও, ফিলিপাইনসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহে। নিউজিল্যান্ডের মাওরিদের মধ্যে উল্কির ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখা যায়। এর উৎপত্তি পলিনেশিয়ায়। পরে অবশ্য প্রথাটি মাওরিদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠে। সেখানে উল্কির স্থানীয় নাম অ্যামোকো। ওরা বাদাম পুড়িয়ে সেই ছাই দিয়ে উল্কি করতো। ওরা এত উল্কিপ্রিয় যে, প্রক্রিয়াটি যন্ত্রণাদায়ক হলেও তারা উল্কি অাঁকতে যন্ত্রণা সহ্য করতো। সৌন্দর্যবোধ ছাড়াও উল্কির ব্যবহার একেক দেশে একেক তাৎপর্য বহন করে। মালয়ের অধিবাসীরা কলেরার প্রতিষেধক হিসেবে শরীরে সাদা, কালো ও লাল রঙের উল্কি অাঁকতো। আবার আফ্রিকার কোনো কোনো আদিবাসী নারী নিজেদের বিধবা বোঝাতে ব্যবহার করে উল্কি। অ্যামেরিয়রা বিশ্বাস করতো উল্কি দিয়ে শুধু এই জীবনে নয়, মৃত্যুর পরেও তাদেরকে ঠিক চিনে নিতে পারবে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা।
রং দিয়ে উল্কি করে শরীরকে নানান রঙে সাজাবার উত্তাল তরঙ্গ মিশরের ফারাওদের যুগেও দেখা গিয়েছিলো। ওল্ড টেস্টামেন্টে ‘পেইন্টেড লেডি’ জিজাবেলের কথা পড়ে মনে হয় বডি পেইন্টিং-এর প্রথাটি মিশর থেকে মধ্য প্রাচ্যে এসেছে।
কালের বিবর্তনে আজকের সভ্য জগতেও নারীর সৌন্দর্য প্রসাধনের পাশে উল্কির প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে সেটি প্রাচীন প্রক্রিয়ায় শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে নয়। অত্যন্ত সহজ উপায়ে আধুনিক নারীরাও উল্কি এঁকে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে থাকেন। আজকাল বিউটি পার্লারে গিয়ে মেয়েরা হাতে, গলায়, পায়ে ও গালে ফুল ফোঁটা এঁকে থাকেন। এগুলো অতীতের উল্কিরই বিকল্প পদ্ধতি। গ্রীসে মেয়েরা শরীরে রং-এর প্রলেপ ব্যবহার করতো। ভূমধ্যসাগরীয় একরকম লতাগুল্ম থেকে অ্যালকানেট নামে লাল রং বের করে তারা গালে লাগাতো। আর মুখে এবং গায়ে সাদা রং-ও ব্যবহার করতো।
এ থেকেই হয়তোবা আধুনিক প্রসাধনে এসেছে গালে রুজ এবং ব্লাশার লাগানোর প্রচলন। আধুনিক প্রসাধনে এগুলো তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন রং-এ। গায়ের রং অনুসারে ব্যবহার করছে আজকের নারীরা সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তুলতে। কে না চায় গাল দুটো দেখাক আপেলের মতো। তাই তো আপেল রং-এর গাল বানাতে ব্যবহৃত হচ্ছে রুজ, ফেস পাউডার, ব্লাসারের মতো প্রসাধনী। বিশ্বের নানাদেশে বহু নামি দামি কোম্পানি প্রসাধন সামগ্রী বানাতে ব্যস্ত। প্রসাধন বিজ্ঞানীরা রীতিমতো গবেষণা চালাচ্ছেন এর মান নিয়ে। সারা বিশ্বে প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসা এক বিরাট লাভজনক ব্যবসা। তাই নিত্য নতুন আঙ্গিকে প্রসাধনের প্রসার ঘটছে সারা বিশ্বে। পাল্লা দিয়ে চলছে একেক কোম্পানি।
রূপ চর্চার ইতিহাস বলতে গেলে ৪ জন রমণীর নাম অবশ্যই আগে আসে। তাঁরা হলেন-
ক. মিশরের ক্লিওপেট্রা
খ. বাইজানটিয়ার থিওডোরা
গ. ফ্রান্সের মাদাম পঁপিদু এবং
ঘ. ভারতের সম্রাজ্ঞী নূর জাহান
কথিত আছে, ক্লিওপেট্রার অপরূপ সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও তিনি ছিলেন বহুগুণের অধিকারিণী। ধাত্রী বিদ্যা ও ভেষজ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। ক্লিওপেট্রা প্রসাধন শিল্পকে পুরোহিতদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে একে চিকিৎসা বিদ্যার সাথে সংযোজন করেন। পরাক্রমশালী ফারাওদের সময় থেকেই প্রসাধনের ওপর পুরোহিতদের আধিপত্য কমতে শুরু করেছিলো। ক্লিওপেট্রার মতো সুন্দরী লাবণ্যময়ী প্রসাধন বিশেষজ্ঞরা যখন ভেষজ বিদ্যার চর্চা শুরু করলেন তখন পুরোহিতদের জাদু মন্ত্র সম্পূর্ণ খসে পড়লো। তাছাড়া আজকাল মুখের চামড়া পেলব রাখতে মেয়েরা যে ‘ফেস মাস্ক’ নামক প্রসাধন ব্যবহার করে- রানী ক্লিওপেট্রাই তার প্রবর্তক। মধু, ডিমের সাদা অংশ এবং ‘গাধার খুর’ নামে এক প্রকার গাছের পাতার রস মিশিয়ে তিনিই এই প্রাকৃতিক অভিনব ফেস প্যাকটি তৈরি করতেন। প্রাচীন মিশরীয় প্রসাধনে আইবিস, বিড়াল, কুমিরের রক্ত, কাঁকড়া, বিছার লেজ, ইঁদুরের নখ, গাধার খুর ইত্যাদি যতসব উদ্ভট উপাদানের নাম পাওয়া যায়, পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয় যে, এগুলো হলো এক রকম উদ্ভিজ্জ্য উপাদানের আটপৌরে নাম।
খৃস্টের সমসাময়িক রোমে প্রসাধন বিস্তারের বর্ণনা দিয়ে গেছেন দার্শনিক প্লিনি এবং কবি ওভিড, যাকে আজও ‘প্রসাধনের কবি’ নামে অভিহিত করা হয়। প্লিনির বই ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ থেকে জানতে পারা যায়, তখনকার দিনে মেয়েরা ঠোঁটে ‘লিপস্টিক’, চোখে ‘আইশ্যাডো’ ছাড়াও গালে ব্যবহার করতো ভিনেগারে ভেজানো ‘পুপেসেরিয়াম’ নামে এক রকম শেকড়, যা থেকে পাওয়া যেতো রুজ কিংবা সিঁদুর। গায়ের রং ধবধবে সাদা করতে ব্যবহার করা হতো চক পাউডার। ওভিডও Ars Amatoria (art of love) নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন 'Cure davit faciem; facies neglecta perbit'- অর্থাৎ উপযুক্ত যত্ন নিলে (রূপ পরিচর্যা করলে) সবাই সুন্দর; অবহেলা করলেই কুৎসিত। ওভিডের অধিকাংশ আলোচনা কেশ চর্চা নিয়ে। প্লিনির আলোচনা পারফিউম নিয়ে।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইজেনটাইন সভ্যতার প্রাক্কালে কনস্ট্যানটিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) শহরটির পত্তনের পর অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেকখানি বেড়ে যায়। ষষ্ঠ শতাব্দীতে সেখানে রাজত্ব করতেন খৃস্টান ধর্মাবলম্বী রাজা জাসটিনিয়ন, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন দ্বিতীয় এক রোম সাম্রাজ্যের। সে স্বপ্ন তার সফল হয় নি। আর তারই রানী থিওডোরা আমাদের দিয়েছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রসাধনের ধারণা। অসামান্য রূপের অধিকারিণী ছিলেন কনস্ট্যানটিনোপল শহরের হিপোড্রোমের ভাল্লুক পালকের মেয়ে। জন্ম তার সাধারণ পরিবারে হলেও নারীত্বে তিনি ছিলেন মহিয়সী আর প্রসাধনে ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানবতী। নানা রকম গাছ-গাছড়া নিয়ে তিনি নতুন নতুন প্রসাধন সামগ্রী তৈরি করতেন তার নিজের গবেষণাগারে। এ ব্যাপারে রাজ চিকিৎসক ইতওস ছিলেন তার সুযোগ্য সহকারী। এছাড়া তিনি ছিলেন প্রসাধন শিল্পের পৃষ্ঠপোষক।
একাদশ শতাব্দীতে কনস্ট্যানটিনোপলের সিংহাসনে আমরা আরেক সম্রাজ্ঞীর অধিষ্ঠান দেখতে পাই। জোই (Zoe) নামে। তিনি যৌবনকে ধরে রেখেছিলেন। সত্যি সত্যিই তাকে বলা হতো অনন্ত যৌবনা। তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে বাইজানটাইন সিংহাসনে তার খুল্লতাত অষ্টম কনস্ট্যানটিনোপল-এর স্থলাভিষিক্ত হন। এই অনন্ত যৌবনা নারী নিজের আবিষ্কৃত প্রসাধন প্রণালী দিয়ে বার্ধক্যকে দূরে রেখেছিলেন। বাহাত্তর বছর বয়সে যখন তিনি মারা যান তখনও তার মুখ দেখাতো ষোড়শী তন্বীর মতো।
উপমহাদেশে রূপচর্চার ইতিহাসও একইভাবে প্রাচীন। মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্যগুলোয় আবরণ, আভরণ ও প্রসাধনে তৎকালীন বঙ্গ ললনাদের সৌন্দর্য কিভাবে বিকশিত হয়ে উঠতো তার নিখুঁত বর্ণনা আমরা পাই। যেমন :
হস্তে লীলা কমলম্ অলকে বালকুন্দানুবিদ্ধং
নীতা লোধ্র প্রসব রজসা পান্ডুতাম্ আননশ্রীং।
চুঢ়াপাশে নবকুরু বকং চারু কনে শিরিষং
সীমন্তে চ তুদুপগমজং যত্র নীণং বধুনাম্।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর উপমহাদেশে যুক্ত হয় আরবীয় প্রসাধন চর্চা। সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান- সব কিছুতেই এগিয়ে চলার জোয়ার বইছিলো। সেসময় এক দিকে আমরা যেমন আবু সিনার মতো হেকিমের নাম শুনতে পাই, তেমনি ইসাক-ইবন মুরাদ বা হাজি-জৈন-আল আত্তার প্রভৃতি প্রসাধন বিশেষজ্ঞরাও সেসময় জন্মেছিলেন। মোঘলরা প্রসাধন চর্চায় এনেছিলো নতুন উদ্যম। জাতি হিসেবে মোঘলরা ছিলো জাঁকজমক প্রিয় এবং প্রসাধন বিলাসী।
মোঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ছিলো অনেক গুণ। তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন, কবিতা লিখতেন, চিত্র শিল্পেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিলো। নূরজাহান সুরুচিসম্পন্ন সাজগোজ অর্থাৎ প্রসাধন ব্যবহার করতেন। তিনি বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীও তৈরি করতে পারতেন। বিশেষ করে সুগন্ধিদ্রব্য (Perfume) প্রস্ত্তত করতেন। বিভিন্ন ফুল থেকে নির্যাস নিয়ে তাদের সংমিশ্রণে নতুন নতুন সুগন্ধি তৈরি করা ছিলো তার শখ।
চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর যে প্রামাণ্য গ্রন্থ ম্যানডেভিল রচনা করে গেছেন তার চবিবশ পরিচ্ছেদেই রয়েছে প্রসাধন সংক্রান্ত আলোচনা। সেখানে সাবানের উল্লেখ আছে। বইটির দশটি অধ্যায়ে জরাকে ঠেকিয়ে রাখার উপায় লিপিবদ্ধ আছে। হেনরীর ছাত্র গাই-দ্য-শৌলক (১৩০০-১৩৬৮ খৃস্টাব্দ) প্রসাধন বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি করেছিলেন। সে দেশে কসমেটিক সার্জারি চালু করার কৃতিত্বও তার।
মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে প্রসাধনের ব্যাপারটা অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলো। রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় এর বাঁধন ছেঁড়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। যদিও রানী চার্চকে সন্তুষ্ট করতে ফরমান জারি করেছিলেন যে, কোনো রমণী যদি কৃত্রিম কেশ, স্পেনীয় হেয়ার প্যাড, মেক-আপ, ফলস হিপ, হাইহিল জুতো ব্যবহার করে সম্রাজ্ঞীর কোনো প্রজাকে প্রলুব্ধ করে বিবাহ করে তবে তাকে ডাইনীর উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে; অথচ রানী এবং তার বোন মেরী ছিলেন অত্যন্ত প্রসাধনপ্রিয়। সুগন্ধির প্রতি রানীর এতই দুর্বলতা ছিলো যে, পার্শ্বচরেরা সবসময় গায়ে গন্ধ মেখে ঘুরে বেড়াতো। শোনা যায়, এলিজাবেথ এতই প্রসাধন ব্যবহার করেছিলেন যে, পরবর্তীতে তার ত্বকের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিলো- শেষ জীবনে তিনি লজ্জায় কারো সামনে খুব একটা বেরোতেন না।
প্রসাধনের ব্যাপারে ইউরোপে নব জাগরণ এনেছিলো ফ্রান্স। ফ্রান্সকে সমগ্র ইউরোপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হতো। তাই আজও ফরাসি পারফিউম সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে।