খোলা কলাম

27-08-2016 04:20:28 PM

ইহলোকে, ইজিপ্টে -পার্থ প্রতিম সিংহ

newsImg

মি বানানো যে খুব কঠিন নয়, (নিন্দনীয় তো নয়ই, প্রাচীন মিশরের ভি আই পি-রা নইলে সে কাজের জন্য জীবনভর খাটবেন কেন!) সেটা বুঝে গিয়েছিলাম ইজিপ্টের মিউজিয়ামে পা রাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই। রেসিপিটা হল, প্রথমে একটা মৃতদেহ নিন। হার্ট আর কিডনি ছাড়া শরীরের ভেতরকার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়িয়ে ফেলুন। সেগুলো প্রতিটাকে আলাদা আলাদা পাত্রে রাখুন। এবার মূল শরীরটাকে আনুন। নানারকম রাসায়নিক, রঞ্জক পদার্থ মাখিয়ে ফেলে রাখুন। জড়িয়ে দিন পরত পরত প্রলেপে। এবার আপনার কাজ শেষ, যা করার করবেন আনুবিস।

আমাদের সারাক্ষণের গাইড আমেনি আগেই সেকথা বলতে বাকি রাখেনি। একজন মানুষের মৃত্যুর পরই একমাত্র তার হৃদপিণ্ডের ওজন জানা যায়। আর সে কাজটা করেন দেবতা আনুবিস। দাঁড়িপাল্লার এক পাত্রে থাকে হৃদপিণ্ড, অন্য পাত্রে একটা উটপাখির পালক। উটপাখির পালকটা নেওয়া হয় বিচারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মাহাত (Ma’et)-এর মাথা থেকে। হৃদপিণ্ডের ওজন পালকের থেকেও হালকা না হলে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে ঢোকার ছাড়পত্র মেলে না, অ্যাহ্মেত (Ammit) নামে এক ভয়ঙ্কর জন্তু-দেবতা কপ্‌ করে হৃদপিণ্ডটা খেয়ে ফেলেন। ব্যাস, খেলা শেষ।  

ইহলোকের ইজিপ্টে পরলোকের বৃত্তান্ত জানতে জানতে ঘুরে বেড়াই। গিজায় গ্রেট স্ফিংক্সের অবয়ব দেখে শিহরন জাগে। সিংহশরীরে নাক-ভাঙা মনুষ্যমুণ্ড নিয়ে সেই ফারাও কাফ্রির আমল থেকে এটি বিরাজ করছে এখানে! অনেকটা সময় কাটল কাফ্রির ফিউনারি টেম্পলের অলিতে-গলিতে আর অলিন্দ-স্তম্ভের ফাঁকে-ফোকরে। গিজা, বিশেষত তার পিরামিডসংকুল এই চত্বরটা হল নেক্রোপোলিস। মৃতের নগরী। কিন্তু ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। এদিকে আমেনি সারাক্ষণ তাড়া দিয়ে চলেছে।

আমেনির পরনে প্যান্টের ওপরে একটা লম্বা জামা, মাথায় হিজাব, গলার হারে একটা গুবরে পোকার (scarab) লকেট। ওটা তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। সেই ভরসায় তার হাত ধরে ধূলিধূসরিত অবস্থায় গ্রেট পিরামিডে চড়তে থাকি। হাঁপাতে হাঁপাতে প্রবেশপথটি অবধি উঠেই মাথা ঘুরে গেল আমার। পাথরের দেওয়াল কেটে তৈরি ছোট্ট দরজা দিয়ে পিরামিডের ভেতরে ঢুকে পড়ছেন পর্যটকরা। কিন্তু ভেতরে দম-আটকানো অন্ধকার, পথ বলতে যদি কিছু থাকে তা এবড়োখেবড়ো। কয়েক হাজার বছরের পুরনো সৌধের গায়ে অবাক বিস্ময়ে হাত বুলাই, কিন্তু সেই অন্ধকার সাঁতরানোর সাহস পাই না।

গ্রেট পিরামিড তৈরি হয়েছিল ফারাও খুফুর আমলে। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে আরও কিছু ছোট ছোট পিরামিড, সেগুলো খুফুর পরিবারবর্গের। খুফুর পুত্র কাফ্রি (Kahfre) আর মেনকারির পিরামিড দুটোও বিশাল।

এখান থেকে পুরনো কায়রোয় যাব, কিন্তু আবিষ্কার করলাম গোরস্থানেও খিদে পায়। স্থানীয় একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে ঝটপট পিটা ব্রেড, তাহিনি (তিল বাটা), ফেলাফেল (ফুলুরির মতো ফাভা বিনসের বড়া) এবং কাবাবের সদ্ব্যবহার করা হল। তারপর আবার পথে। গন্তব্য নীলনদ পেরিয়ে ওল্ড কায়রো।

যেতে গিয়ে নাস্তানাবুদ। নোংরা রাস্তাঘাট, অসম্ভব যানজট। পুরনো মডেলের গাড়ির মিছিল। বায়ুদূষণে কলকাতাকেও হার মানায়। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নীলনদও যেন একটা বদ্ধ জলা। পুরনো ভাঙাচোরা বাড়িঘর, কিন্তু প্রত্যেকটি বাড়ির ছাদে অসংখ্য মন্দিরস্থাপত্য। এ-ও এক বিস্ময়। আমেনিকে বলতেই সে হেসে খুন। মন্দির নয়, ওগুলো নাকি পায়রার বাসা। এখানে পায়রার মাংসের নাকি খুব কদর, তা বলে এভাবে পায়রা পোষার হিড়িক থাকবে ভাবতে পারিনি।

ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের কথা শোনা ছিল, ওল্ডকায়রোতে দেখলাম হ্যাঙ্গিং চার্চ। শুধুমাত্র দু’টি স্তম্ভের ওপরে নির্মিত এক অসাধারণ স্থাপত্য। দেওয়ালে আবলুশ কাঠ আর গজদন্তের কারুকার্য। কাছেই রয়েছে আর-এক অনন্য স্থাপত্য, বেন এজরা সিনাগগ। কাঠের এমন সূক্ষ্ম ফিলিগ্রি আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

মিউজিয়াম অফ ইজিপ্টের চত্বরে পৌঁছে মনে হয়েছিল কলকাতায় পৌঁছে গেছি, সামনে যেন দেখছি লাল ইটের তৈরি রাইটার্স বিল্ডিং! মিউজিয়ামের একতলায় আছে কয়েক হাজার বছরের পুরনো প্যাপিরাসে লেখা ছেঁঁড়াখোঁড়া পুথিপত্র। আছে অসংখ্য মুদ্রা, কফিন, মূর্তি। দোতলায় উঠেই চমত্‌কৃত হই। ‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস’-এর সমাধিমন্দিরগুলো থেকে তুলে আনা ফারাওদের সামগ্রীতে হলগুলো পূর্ণ। তুতেনখামেনের সোনার কফিন থেকে শুরু করে এগারো কিলো সোনায় তৈরি মুখোশ। সেই কাজলটানা চোখ, লম্বা দাড়ি, বিচিত্র শিরস্ত্রাণ দেখে সম্মোহিত হয়ে পড়ি।

আর আছে মমি। শৃগালদেবতা আনুবিসের সঙ্গে সাক্ষাত্‌ হল এখানেই। তুলাদণ্ডে একটা পালক আর কোনও মানুষের হৃদপিণ্ড নিয়ে বসে আছেন। পাশে অপেক্ষা করছেন কুমির-সদৃশ মৃত্যুর দূত অ্যাহ্মেত। কোনও এক নশ্বরের মৃত্যু-পরবর্তী ভবিতব্য নির্ধারিত হতে চলেছে।

আমাদের ভবিতব্য অবশ্য আমেনির হাতে। এইদিন আমাদের যাওয়ার কথা ছিল তাহ্‌রির স্কোয়ারে। সেই বিখ্যাত বিপ্লবমাখা চত্বর, আমরা যখন গিয়ে পৌঁছেছি তখন তার আগুন ধিকধিক করছে। অবাক হয়ে দেখলাম স্কোয়্যারটাকে এড়িয়ে নীলনদের গা ঘেঁষে মিউজিয়ামের পেছন দিকটায় পার্ক করা হল আমাদের গাড়িটাকে। আমাদের চোখে-মুখে প্রশ্ন দেখে আমেনি বলল, না, না, তাহ্‌রির স্কোয়্যারে নামা চলবে না। তেমন হলে ফেরার পথে... বরং মিউজিয়ামটাই... 

আসলে ব্যাপারটা হল, পর্যটক লক্ষ্মী। হঠাত্‌ কিছু গোলযোগের পরিণামে ট্যুরিস্টের স্রোতে ভাটা পড়া মোটেই কাম্য নয়। তাই পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না এরা। একইভাবে, সুগন্ধি, মশলাপাতি আর শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত খান এল-খালিলি বাজারটাকেও বুড়ি-ছোঁয়া করে ঘুরিয়ে আনল আমেনি। রাগ ভুলতে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকতে হল। পিটা ব্রেডের সঙ্গে শোয়ারমা (সারাদিন নরম আঁচে গ্রিল করা নানারকম মাংসের ফালি) দিয়ে মন ভাল করতে হল। সঙ্গে তাহিনি আর হুমুশ (মটরদানা বাটা আর নানারকম মশলা মেশানো টাকনা)। আর ছিল বাবা গানুশ, যা আসলে আমাদের প্রিয় বেগুনপোড়া। শেষ পাতে (আমাদের খাজা বা বালুসাই গোত্রের) বাখলাওয়া। তার স্বাদ স্বর্গীয়।