01-04-2018 12:09:52 PM
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে পড়েছে বিএনপির জন্য। দ্রুত খালেদা জিয়া কারামুক্ত হবেন বলে দলের নেতাকর্মীরা আশা করলেও আইনি মারপ্যাঁচে তা সম্ভব হচ্ছে না। এখন তার চিকিৎসা কি দেশে হবে, নাকি বিদেশে হবে- তা নিয়েও দেখা দিয়েছে নতুন বিতর্ক। এদিকে, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আইনি লড়াইয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন আইনজীবীরা। এ কারণে ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দল ও জোটের বাইরে দেশে-বিদেশে সমমনাদের প্রকাশ্যে সমর্থন আদায় প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হয়ে পড়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে আজ রোববার দলের যৌথ সভা আহ্বান করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি স্বৈরতান্ত্রিক দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তারা বিএনপি এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে আগামীতে আবারও একটি একতরফা নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র করছে। সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার নানা কূটকৌশল করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে এবং থাকব। সব সংকট মোকাবেলা করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন তারা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে তারা আগামী নির্বাচনে লড়বেন।
কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের মধ্যেই বিএনপির সামনে তৈরি হয়েছে নতুন ইস্যু তার অসুস্থতা। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে বেশ ধূম্রজাল। অসুস্থতার জন্য তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সাক্ষাৎ করতে পারেননি। অবশ্য কারাগারের চিকিৎসক বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন নতুন করে অসুস্থ হননি। আওয়ামী লীগ চিকিৎসকদের পরামর্শে কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলছে। বিএনপি বলছে, আগে তাকে মুক্তি দিতে হবে। এরপর খালেদা জিয়া নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন, তিনি দেশে চিকিৎসা নেবেন নাকি বিদেশে। চেয়ারপারসনের অসুস্থতা এবং চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় তৈরি হয়েছে।
বিএনপির কিছু নেতা মনে করেন, সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে অতিরিক্ত উৎসাহী মনে হচ্ছে। তাদের মনে কোনো দুরভিসন্ধি থাকতে পারে। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়া ঠিক হবে না। বিদেশে গেলে নির্বাচনের আগে তার দেশে ফেরা নিয়ে নতুন জটিলতা দেখা দিতে পারে। গুরুতর অসুস্থ না হলে দেশেই তার চিকিৎসা হওয়া উচিত। অন্যদিকে দলের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, সবার আগে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। সুস্থতার জন্য প্রয়োজনে তাকে বিদেশে পাঠানো উচিত। অন্যথায় তার কিছু হলে তার দায়ভার কে নেবেন?
সূত্র জানায়, এ পরিস্থিতিতে আজকে দলের যৌথ সভায় নেতাদের মতামত নেওয়া হবে। বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দেশে না বিদেশে, তা ঠিক করা হবে। এ ব্যাপারে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামতকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সমকালকে বলেন, তারা অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করছেন। মুক্ত হওয়ার পরই অসুস্থতার ধরন দেখে তার চিকিৎসা কোথায় করাবেন- সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আইনি লড়াই :খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনায় সিনিয়র ও জুনিয়র আইনজীবীদের বিভক্তির বিষয়টি সুরাহা হচ্ছে না। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনায় আইনজীবী প্যানেল থেকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে বাদ দেওয়া হয়েছে- এমন সংবাদে বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করে। সিনিয়র নেতারা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন মামলা পরিচালনার একক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার প্রবণতায় ক্ষুব্ধ জুনিয়র আইনজীবীরা। এ কারণে খোকনের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ঘায়েল করার সূক্ষ্ণ চেষ্টাও হচ্ছে। এতে দল ও জিয়া পরিবারের ক্ষতি হয়েছে বলেও বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করছেন। তবে এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে উচ্চবাচ্য করছেন না।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের একটি অংশ জানিয়েছে, শুরুতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার ব্যাপারে আইনজীবীরা কিছুটা গা-ছাড়া ছিলেন। এ কারণে মামলা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনজীবীদের ওপর দল-সমর্থিত কয়েকজন জুনিয়র ব্যারিস্টার ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ কারণে সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
সূত্র জানায়, এ ঘটনার পর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দু'বার টেলিফোন করেন। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আইনি লড়াই এবং দলকে এগিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানান।
সন্দেহ, ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনা বিঘ্নিত :আইনজীবীদের মতো দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে কোনো কোন্দল দেখা না গেলেও সন্দেহ আর অবিশ্বাসের ছায়া লক্ষ্য করা গেছে। কোনো নেতাই যেন কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে নিয়মিত বৈঠকে বসছেন নেতারা। ধারাবাহিক এই বৈঠক থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে না দলের মধ্যম সারির নেতাদেরও।
সূত্র জানায়, নেতাদের পরস্পরের এমন মনোভাবের কারণে কোনো নেতা নিজে থেকে রাজনৈতিক কিংবা সাংগঠনিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। সমন্বিত মতামত ছাড়া কোনো কার্যক্রমও আর নেই দলটির। এ অবস্থায় দল পুনর্গঠন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনী প্রস্তুতিসহ সব সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তারা নিয়মিত বৈঠক করছেন। সব সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধভাবেই নেওয়া হচ্ছে। দলের মহাসচিব সব সিনিয়র নেতাকে নিয়ে এ বৈঠকের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে বিএনপির ঐক্য সর্বোচ্চ অটুট রয়েছে।
থমকে গেছে বৃহত্তর ঐক্য :দল ও জোটের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে 'বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য' গড়ার প্রক্রিয়াও থমকে গেছে। খালেদা জিয়ার কারাবন্দি দীর্ঘায়িত হওয়ায় সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা বেশিদূর এগোচ্ছে না। বিএনপি চেয়ারপারসনকে ছাড়া সমমনা দলগুলো ঐক্য গড়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে রাজি হচ্ছে না। তারা অপেক্ষা করছে, খালেদা জিয়ার কারামুক্তির। তবে তার কারামুক্তি আরও দীর্ঘায়িত হলে তারা কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিএনপির একজন নেতা বলেন, অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন এখনও দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছেন। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তাদের নেতৃত্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করার কথা বলা হয়েছে।