22-02-2018 12:45:17 PM
চুরি প্রতিরোধসহ যানবাহনের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার, গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি এবং এ খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বছর ছয়েক আগে থেকে বিআরটিএ গাড়িতে ডিজিটাল নম্বর পেস্নট ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) স্টিকার লাগানো শুরম্ন করলেও এর সামান্য সুফল এখনো মেলেনি। অথচ শুধুমাত্র এ কাজের জন্য সংশিস্নষ্ট কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে যানবাহনের মালিকদের কাছ থেকে প্রায় পৌনে ছয়শ' কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এ খাতে এখনো প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে এর বিপরীতে কবে নাগাদ প্রাপ্য সুবিধা কতটা দেয়া যাবে তা নিয়ে খোদ বিশেষজ্ঞরা এখনো ঘোর অন্ধকারে।
অথচ শুধুমাত্র সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে রেক্ট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বরপেস্নট, আরএফআইডি ট্যাগ এবং স্মার্ট রেজিস্ট্রেশন কার্ড বা ভেহিকল ওনারশিপ কার্ড সম্পন্ন করতে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন বিএমটিএফকে এ প্রকল্পের গোটা কাজটি দেয়া হয়েছে। যদিও উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এ কাজ দেয়া হলে গ্রাহকরা আরও কম টাকায় এই সেবা পেত। ওই সময় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, 'এত বড় কাজ সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বিএমটিএফকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে করতে গেলে সময় বেশি লাগত এবং পুরো বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা ছিল।'
পরিবহন সংশিস্নষ্টরা বলছেন, এ প্রকল্পের ষোলো আনাই মিছে। শ্রেফ ভাওতাবাজি দিয়ে বিআরটিএ পরিবহন মালিকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা ও জবাবদিহিতা না থাকায় এ প্রকল্প সফলতার মুখ দেখেনি। সহসাই তেমন কিছু হবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তাদের ভাষ্য, ডিজিটাল নম্বর পেস্নটের মেয়াদ সাত বছর। মেয়াদ শেষে এজন্য নতুন করে টাকা জমা দিতে হবে। এ নিয়ম মানলে যেসব যানবাহন মালিক ২০১২ সালে ডিজিটাল নম্বর পেস্নট নিয়েছেন তাদের এ পেস্নটের মেয়াদ সহসাই শেষ হয়ে যাবে। অথচ এ সময়ের মধ্যে তারা এর কোনো সুফল ভোগ করতে পারেনি। অর্থাৎ তাদের পুরো টাকাই গচ্ছা গেছে।যদিও বিআরটিএ বলছে, শিগগিরই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেবার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। গাড়ি চুরি করতে বা ডিজিটাল নম্বর পেস্নট সংযুক্ত গাড়ির অবস্থান জানতে প্রাথমিকভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সেন্ট্রাল সার্চিং টাওয়ার স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরম্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো মহাসড়কে তা স্থাপন করা হবে। এতে ডিজিটাল নম্বর পেস্নটের পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে। তবে এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় জানাতে পারেননি বিআরটিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই প্রযুক্তি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পূর্ণাঙ্গ জরিপ করার প্রয়োজনীয়তা থাকলে তা না করেই রাজধানীতে মাত্র ১২টি স্থানে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) স্টেশন স্থাপন করা হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এসব স্টেশনে বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু গাড়ির অবস্থান শনাক্ত করা হলেও তা চাহিদা পূরণ করছে না। ঢাকার বাইরে এ স্টেশন না থাকায় প্রকল্পের লক্ষ্য পূরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, ছয় বছর পার হলেও আরএফআইডি শনাক্ত করার এসব যন্ত্র এখনও পুলিশকে দেয়া হয়নি। প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার না দেয়ায় বিআরটিএর সার্ভারে থাকা গাড়ির তথ্য সম্পর্কে জানতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ফলে ট্রাফিক পুলিশকে সনাতন পদ্ধতিতে রাস্ত্মায় দাঁড় করিয়ে গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করে মামলা করতে হচ্ছে।
ডিজিটাল নম্বর পেস্নট প্রকল্পের সুফল না পাওয়ার কথা স্বীকার করে বিআরটিএ সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী বলেন, ঢাকায় ১২টি আরএফআইডি স্টেশন বসানো হয়েছে। এতে স্বল্প দূরত্বের গাড়ির অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বেশি দূরত্বের গাড়ির অবস্থান চিহ্নিত করতে হলে আরও শক্তিশালী ডিভাইস ও টেকনোলজির ব্যবহারের প্রয়োজন হবে। তবে বর্তমানে এসব ডিভাইস ব্যবহারের কারণে গাড়ি চুরি বন্ধ না হলেও চুরির সংখ্যা কমেছে বলে দাবি করেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাড়িতে ডিজিটাল নম্বর-পেস্নট বসানো হলেও এগুলো মনিটরিং করার কোনো সিস্টেম পুলিশকে দেয়া হয়নি। তাই চুরি রোধসহ যানবাহনের কোনো নিরাপত্তায় পুলিশ এ সিস্টেমের কোনো সুবিধা নিতে পারছে না।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা জানান, পর্যাপ্ত আরএফআইডি স্টেশন ও টাওয়ার স্থাপন করে ডিজিটাল নম্বর-পেস্নট যুক্ত গাড়ির তথ্য সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে নজরদারি করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় চোরাই গাড়ি উদ্ধার করা সহজ। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক, মহাখালী, গুলশান-২, কুড়িল বিশ্বরোড, গাবতলী, ফার্মগেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, শাহবাগ, কাকরাইল, গুলিস্ত্মান এবং বুড়িগঙ্গা সেতু-১ ও বুড়িগঙ্গা সেতু-২ এই ১২টি জায়গায় যে আরএসআইডি স্টেশন রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এছাড়া বিআরটিএ থেকে তথ্য বিনিময়ে সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে চুরি হওয়া গাড়ির তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় না।
তাদের ভাষ্য, যে সেবা দেয়ার কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে, তা পুরোপুরি সফল করতে হলে পর্যায়ক্রমে সারা দেশে আরও বিপুল সংখ্যক আরএফআইডি স্টেশন ও টাওয়ার স্থাপন করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আরএফআইডি রিডার এবং বিআরটিএ সার্ভারে রক্ষিত সব যানবাহনের তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাসময়ে দিতে হবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে বিআরটিএ সার্ভার থেকে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় সব তথ্য পেতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার আপডেট করা জরম্নরি।
এদিকে কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই বিশেষ সেবা দেয়ার নামে সব ধরনের যান্ত্রিক যানবাহন থেকে নির্ধারিত অংকের অর্থ গ্রহণের বিষয়টিকে বিআরটিএর বড় ধরনের প্রতারণা বলে মন্ত্মব্য করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের ভাষ্য, 'নির্ধারিত সেবা দিয়েই গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা উচিত, সেবা দেয়ার কথা বলে নয়।'
অপরিকল্পিত এ কার্যক্রমের জন্য পরিবহন বিশেষজ্ঞরা এককভাবে বিআরটিএকে দায়ী করেন। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, 'একটা প্রজেক্ট যদি হাতে নেই, তাতে সাফল্য না আসলে এর জন্য দায়ী কে তাকে যদি দোষী সাব্যস্ত্ম করে শান্ত্মি না দেয়া যায় তাহলে প্রজেক্টগুলো কবে সফল হবে তা আমরা ধারণাও করতে পারব না।'
প্রসঙ্গত, ফোর হুইলার ও থ্রি হুইলার গাড়ির জন্য ডিজিটাল নম্বর পেস্নটের ফি ৪ হাজার ৬২৮ টাকা এবং মোটর সাইকেলের (টু-হুইলার) ডিজিটাল নম্বর পেস্নটের জন্য ২ হাজার ২৬০ টাকা ফি আদায় করা হচ্ছে।
বিআরটিএ এর এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত্ম সারাদেশে প্রায় ১৪ লাখ যানবাহনে ডিজিটাল নম্বর পেস্নট লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে হালকা ও ভারী যানবাহন (ফোর-থ্রি হুইলার) সোয়া ১১ লাখ এবং পৌনে ৩ লাখ মোটরসাইকেল ডিজিটাল নম্বর পেস্নটের আওতায় আনা হয়েছে। এ হিসেবে ডিজিটালাইজেশনের নামে এরইমধ্যে পৌনে ছয়শ' কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বিআরটিএ।
এদিকে এ ডিজিটাল নম্বর পেস্নট লাগাতেও ভোগান্ত্মির শেষ নেই। নির্ধারিত ফি ব্যাংকে জমা দেয়ার পরও যানবাহন মালিকদের তা পেতে মাসের পর মাস বিআরটিএতে ঘুরতে হচ্ছে। গ্রাহকের মোবাইল ফোনে নম্বর পেস্নট লাগানোর এসএমএস পাঠানো হলেও তা সময়মতো মিলছে না। আবার নম্বর পেস্নটটি সাধারণ স্ক্রু দিয়ে লাগানোর ফলে সেটি দুর্ঘটনায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত্ম হলে বা খুলে গেলে তা আর কাজে আসছে না।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ক্রয়সংক্রান্ত্ম বিধিমালার (পিপিআর-২০০৮) ৭৬, এর ১(ক) এবং (ছ) ধারা মতে, বিএমটিএফকে এই কাজ দেয়া হয়। ৭৬, এর ১(ক) ধারায় বলা হয়েছে, 'ক্রয়কারী কেবল একজন সরবরাহকারী বা ঠিকাদারকে দরপত্র দাখিলের জন্য আহ্বান জানাইতে পারিবে যদি পেটেন্ট, ব্যবসায়িক গোপনীয়তা এবং একক স্বত্বাধিকারের কারণে একই ধরনের পণ্য প্রস্তুতকরণে অন্যদেরকে নিবৃত্ত রাখা হয়, সেই ক্ষেত্রে একক স্বত্বাধিকারভুক্ত পণ্য ও সংশিস্নষ্ট সেবা কেবলমাত্র একক স্বত্বাধিকারীর নিকট হইতেই ক্রয় করা যাবে।'
৭৬ এর ১(ছ) ধারায় বলা আছে, 'বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি মালিকানাধীন শিল্প ও কারখানা হইতে সরকারের নিজস্ব অর্থে পণ্য ও সংশিস্নষ্ট সেবা ক্রয় করা যাবে।'
অবশ্য সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত্ম কেন্দ্রীয় কারিগরি ইউনিটের (সিপিটিইউ) একজন কর্মকর্তা বলেন, বিআরটিএর সঙ্গে বিএমটিএফের চুক্তিটি পিপিআরের আওতায় পড়ে না। কারণ সরকারের বাজেট থেকে কোনো অর্থ ব্যয় করে পণ্য বা সেবা কিনলেই পিপিআর অনুসরণ করতে হয়। এখানে যানবাহন মালিকদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সেবা দেয়া হবে।