22-02-2018 12:18:38 PM

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ভাষাশহীদদের স্মরণ জাতির

newsImg

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রম্ন গড়ায়ে ফেব্রম্নয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...।' হাতে ফাগুনে ফোটা ফুল; কণ্ঠে বিষাদমাখা চিরচেনা এ গান- একের পর এক সারিবদ্ধ মানুষের মিছিল। শিশু-কিশোর, তরম্নণ-তরম্নণী, যুবা-বৃদ্ধ সবাই মিশেছে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর ঢলে। ভোরের ঊষা পূর্বাকাশে রাঙা আভা ছড়িয়ে দেয়ার আগেই ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বাঙালির শোক আর অহঙ্কারে গড়া সারাদেশের শহীদ মিনার। নানা আয়োজনে গর্ব আর শোকের এ দিবসটি পালন করল জাতি। তবে দিনের মূল কর্মসূচি ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ঘিরে।
একুশের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্ত্মবক অর্পণ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপরই পুষ্পস্ত্মবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি সম্মান জানান। এ সময় বেজে ওঠে অমর একুশের গানের সেই চিরচেনা করম্নণ সুর। এরপর প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নিয়ে পুষ্পস্ত্মবক অর্পণ করেন। 

রাষ্ট্রীয় গুরম্নত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শহীদ মিনারে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। রাত ৩টা থেকে ভোর পর্যন্ত্ম ভিড় কিছুটা কম থাকলেও সকালের আলো ফোটার পর প্রভাতফেরির সারি শহীদ মিনার থেকে পলাশীর মোড় পেরিয়ে আজিমপুরে গিয়ে ঠেকে।
সকাল ৬টা ১০ মিনিটে ফুল হাতে শহীদ মিনারে আসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরম্নল হুদা। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তিনি বলেন, 'সর্বস্ত্মরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা সেটা মেনে চলি। নির্বাচন কমিশন দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষাই ব্যবহার করে, শুধু বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ব্যবহার করে।'
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, 'আমাদের একদিনের বাঙালি হলে চলবে না। বছরে একদিন প্রভাতফেরি বা নববর্ষে একদিন পান্ত্মা-ইলিশ খেলেই চলবে না। আমাদের প্রতিদিনের বাঙালি হতে হবে।' 
বেলা যত বাড়ে শহীদ মিনারে বাড়ে তত জনস্রোত। দীর্ঘ লাইনে ফুল আর ছোট ছোট পতাকা হাতে অপেক্ষায় হাজারো মানুষ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারম্নজ্জামান বলেন, 'যারা একুশের চেতনা ধারণ করে, যারা একুশকে লালন করে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত্ম হতে পারে না।'
একুশের অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রভাতফেরিতে শহীদ মিনার ফুল দিতে আসেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঐতিহ্যিক মর্যাদা রয়েছে, একুশে ফেব্রম্নয়ারির আয়োজন তারই অংশ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অনেকেই এ আয়োজনে সহায়তা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই গুরম্ন দায়িত্ব পালন করতে পেরে গর্বিত।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফুল দিতে আসেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন এবং দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপকে সঙ্গে নিয়ে।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কাদের সাংবাদিকদের বলেন, 'বাহান্নর শহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা যে ভাষা পেয়েছি, তার পথ ধরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা একাত্তরে দেশ স্বাধীন করেছি। আমি জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানাই, তারা যেন ৩০ কোটি বাঙালির বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।'
সকাল ১১টা ২৫ মিনিটে শহীদ মিনারে এসে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় দলের নেতাকর্মীরা একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসেনি। 
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দল ও সংগঠন ছাড়াও ছাত্র, যুব, নারী, শ্রমিক, শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো এবং শত শত মানুষ সারিবদ্ধভাবে একে একে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা জানান। এ সময় মাইকে অমর-করম্নণ সুর বাজানো ছাড়াও ধারাভাষ্যকাররা অবিরাম কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা আবৃত্তি করেন। 
এ সময় অনেকের মুখেই প্রশ্ন ছিল- বিশ্ব দরবারে আমাদের এ আত্মত্যাগ আর বীরত্বের মহিমা স্বগর্বে স্বীকৃতি পেলেও এখনো কেন বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি দেশের সর্বস্ত্মরে। এ ভাষা কেন আজও উপেক্ষিত, এ ভাষা কেন দূষিত আজও? 
এদিকে শুধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারই নয়, সারাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে দিবসটি। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে একুশকে ঘিরে ছিল নানা কর্মসূচি। এ দিবসকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। শহীদ মিনারে আসা নগরবাসীর পোশাকে ছিল একুশের চেতনার ছাপ। কপাল জড়ানো ছিল জাতীয় পতাকায়। পোশাকে সাদা আর কালো রঙের ব্যবহার বেশি। তাতে খচিত ছিল বর্ণমালা, কবিতার চরণ বা গানের কলি। আবার লাল-সবুজের বাংলাদেশকে ধারণ করতে দেখা গেছে কারও কারও পোশাকে। রাস্ত্মার পাশে ছোট ছোট দোকান এবং হাতে করে ফেরিওয়ালাদের ছোট ছোট পতাকা, একুশের বাণী লেখা মাথায় বাঁধার ফিতা, শহীদদের ছবিসহ পোস্টকার্ড বিক্রি করতে দেখা যায়। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বেশির ভাগ মানুষকে বইমেলায় ঢুকতে দেখা গেছে। আর একুশের প্রথম প্রহরের কথা বিবেচনায় রেখে বুধবার বইমেলার দরজা উন্মুক্ত হয়েছে সকাল ৮টায়। ফলে সকাল থেকে মেলায় ছিল ব্যাপক ভিড়।
বরাবরের মতো এবারও একুশে ফেব্রম্নয়ারি ছিল সাধারণ ছুটির দিন। বাঙালির জন্য শোক এবং গৌরবের এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, জাতীয় সংবাদপত্র, বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম রেডিও দিনভর বিশেষ আয়োজন করে। একুশে ফেব্রম্নয়ারির তাৎপর্য তুলে ধরে জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ প্রকাশনার আয়োজন করে। সরকারের পক্ষ থেকে বের করা হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। একুশের প্রথম প্রহরে বিটিভির সৌজন্যে অন্য চ্যানেলগুলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। 
মহান একুশে ফেব্রম্নয়ারি উপলক্ষে পত্রিকা অফিস বন্ধ থাকলেও বিশেষ ব্যবস্থায় কাজ চলে এদিন। রাজধানীর এই ব্যস্ত্মতার পাশাপাশি সারাদেশে একুশকে ঘিরে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ। একুশের গান, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য আর নাটকে নাটকে মুখর হয়ে ওঠে প্রতিটি প্রাঙ্গণ। দেশের প্রায় সব শিক্ষাঙ্গনে স্থায়ী এবং অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।