13-02-2018 06:11:49 PM
মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পাঠানো চিঠি গায়েব করে সেই চিঠিতে নতুন করে জালিয়াতি করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার জাল সনদ ব্যবহার করে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি নেওয়া শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই চিঠি পাঠিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
চিঠি গায়েব করে জালিয়াতকারীরা তাদের অনুকূলে তথ্য ব্যবহার করে তা ফের উপস্থাপন করে। এই প্রক্রিয়ায় সচিবালয়ের পত্র গ্রহণ শাখা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। সনদ জালিয়াতির বিষয়টি তদন্ত করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ শাখা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব। এ গৌরবকে যারা কলঙ্কিত করেছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিয়োগ পাওয়া বেশ কয়েকজন কনস্টেবলের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ করেছে। জালিয়াতির বিষয়টি উদ্ঘাটন করা হবে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সনদ জালিয়াতি করে পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া ওই মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে যে চিঠি পাঠিয়েছে তাও জালিয়াতি হয়েছে বলে আমরা অবগত হয়েছি। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক চাকরিচ্যুতিসহ ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে পুলিশে প্রায় ৫০ হাজার লোক নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে নিয়োগ করা হয় প্রায় ১৪ হাজার কনস্টেবল। তাদের মধ্যে শতাধিক কনস্টেবল ভুয়া সনদ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেতে হলে আগে সনদ যাচাই করে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে; কিন্তু পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই শর্ত শিথিল করা হয়। নিয়োগের পর সনদ যাচাই-বাছাই করে ভুয়া প্রমাণিত হলে চাকরিচ্যুত এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের শর্তে তাঁদের চাকরি দেওয়া হয়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাই ছাড়া চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। আর ভুয়া সনদ ব্যবহার করে যাঁরা চাকরি নিয়েছেন তাঁদের চাকরিচ্যুত করে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিবালয়ের বাইরে লিংক রোডে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিবালয়ের ভেতরে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সনদ জালিয়াতির চিঠি সচিবালয়ের পত্র গ্রহণ শাখায় জমা দেয়। প্রথম দফায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় চিঠি দেয় গত বছরের ১৫ অক্টোবর। ওই চিঠিতে ১৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার সনদ প্রত্যয়ন করা হয়। এর মধ্যে ১ থেকে ৪৭ ক্রমিক পর্যন্ত ৪৭ জনের সনদে কোনো ত্রুটি ছিল না। ৪৮ থেকে ৮৪ ক্রমিক পর্যন্ত ৩৭ জনকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে প্রত্যয়ন করা হয়। ক্রমিক ৮৫ থেকে ৮৯ পর্যন্ত পাঁচজনকে পরামর্শসহ সাময়িক প্রত্যয়ন করা হয়। ক্রমিক ৯০ থেকে ১১০ পর্যন্ত ২১ জনকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) শর্তে সাময়িক প্রত্যয়ন করা হয়। ১১১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত ৪০ জনকে কাগজপত্রের অভাবে প্রত্যয়ন করা হয়নি। ক্রমিক ১৫১ থেকে ১৬০ পর্যন্ত ১০ জনের তথ্য ছিল মিথ্যা ও ভুয়া। মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নেওয়ার জন্য শেষের ১০ জনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা অবহিত করতেও বলা হয়।
এ-সংক্রান্ত চিঠি সচিবালয় পত্র গ্রহণ শাখা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছলে দেখা যায় ১ থেকে ৪৭ জনের স্থলে ১ থেকে ৫৬ জনের সনদ বৈধ বলা হচ্ছে। ১৫১ থেকে ১৬০ নম্বর ক্রমিকের যে ১০ জনের সনদ জাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ৯ জনের নাম বৈধতার তালিকায় সংযুক্ত করে দেওয়া হয়।
গত বছর ২২ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য এক চিঠিতে চারজনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, এঁরাও মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্ত করে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই দুই চিঠির বাইরে আরো একাধিক চিঠিতে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে কনস্টেবল পদে চাকরি নেওয়ার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। পাশাপাশি গত বছর ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। একই চিঠিতে পুলিশ নিয়োগসংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্রগুলো একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে দিয়ে যাচাই করতে বলা হয়। সর্বশেষ গত ২৮ জানুয়ারি জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি নেওয়া কনস্টেবলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেওয়া হয়। আগের চিঠিগুলোর জবাব না পাওয়ায় হতাশাও প্রকাশ করা হয়।
সচিবালয় পত্র গ্রহণ শাখা পরিচালনা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বাইরে থেকে সচিবালয়ে আসা সব চিঠি তারা গ্রহণ করে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে ফরোয়ার্ডিং লেটারসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট আসে। আমরা জানিও না প্যাকেটের ভেতর কী রয়েছে। ফরোয়ার্ডিং লেটার দেখে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ডকুমেন্টগুলোও পত্র গ্রহণ শাখায় খোলা হয়নি। সম্প্রতি এ নিয়ে তোলপাড় চলছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের কাছে বিভিন্ন তথ্য জানতে চাইছেন। তদন্ত কর্মকর্তারাও আসছেন।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, যেকোনো চাকরিতে ৩০ ভাগ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত। এসব পদে লোক পাওয়া না গেলে পদ শূন্য থাকে। বিভিন্ন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিরা সেখানে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তারা চাকরিও করেন এক বছর বেশি। এসব কারণে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির ঘটনা বেড়েছে।
কনস্টেবল নিয়োগের ভূয়া সনদ ধরা পড়া এবং তা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের কাজও হতে পারে। এই সিন্ডিকেটে যুক্ত থাকতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। আর এখানে পুলিশও জড়িত। সরকারের একটা মন্ত্রণালয় ভুয়া সনদ ধরেছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। দফায় দফায় চিঠি দিয়ে তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ তা করেনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলেই রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে লোক নিয়োগের ব্যবস্থা করে। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও তারা অর্থের বিনিময়ে জালিয়াতি করে আসছে। ২০১৫ সালে নিয়োগ পাওয়া বেশ কজন কনস্টেবলের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।