পড়াশুনা, পরীক্ষা ও ফলাফল

12-02-2018 02:39:59 PM

প্রশ্ন ফাঁসের হোতাদের মুখে ভয়ংকর তথ্য

newsImg

এসএসসি এক্সাম কোয়েশ্চেন ২০১৮’ নামের ফেসবুক পেজ থেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘এর পরও আমরা ফাঁস করেছি এবং করে যাব।’ তাদের দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে একজন প্রতিবেদককে বলেন, ‘কেউ আমার কিচ্ছুটি করতে পারবে না।’ তাঁর এই অহমিকা টিকল না। হুমকির পাঁচ দিনের মাথায় প্রশ্ন বিক্রেতা চক্র গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েছে। পেজটি চালাচ্ছিলেন বরকত উল্লাহ (২৬), আমান উল্লাহ ওরফে আলামিন (২৪) ও আহসান উল্লাহ (১৯) নামের তিন ভাই। এর মধ্যে আমান উল্লাহর কাছ থেকেই দুই লাখ দুই হাজার চার শ টাকা পাওয়া গেছে, যা তিনি মাত্র দুই পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি করে পান। চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসা তিন ভাই ইন্দিরা রোডের একটি বাসায় থেকে লেখাপড়া করছিলেন। গত শনিবার গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে এই তিন ভাইসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে নবম শ্রেণির ছাত্র থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও আছেন।

এ ছাড়া পূর্ব রাজাবাজার এলাকা আরবিএন হোস্টেল থেকে আনিছুর রহমান (২০) নামের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-২। র‌্যাব-২ জানায়, শনিবার রাতে পূর্ব রাজাবাজার এলাকা আরবিএন হোস্টেল থেকে গ্রেপ্তারকৃত আনিছুর একটি চক্রের হোতা। তিনি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। হোস্টেলে থাকাকালে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মিসাইল গ্রুপ ও আইসিটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে মিসাইল গ্রুপের অ্যাডমিনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করতেন। টাকা নিতেন বিকাশে।

গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বাকি ১১ জনের নাম রাহাত ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (২৩), সুজন (২০), জাহিদ হোসেন (২০), সুফল রায় শাওন (১৮), আল আমিন (২০), সাইদুল ইসলাম (২০), আবির ইসলাম নোমান (১৬), শাহাদত হোসেন স্বপন (১৮), ফাহিম ইসলাম (২০) ও তাহসিব রহমান (১৭)। এর মধ্যে তাহসিব ও সুজন এসএসসি পরীক্ষার্থী। অভিযানকালে প্রশ্নপত্র ফাঁসে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, ২৩টি স্মার্টফোন ও দুই লাখ ২৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর নিউ মার্কেট, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী ও শেরেবাংলানগর থানায় পৃথক মামলা করেছে পুলিশ। ডিবির সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১১ জন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমোতে অর্ধশতাধিক গ্রুপ চালায়।

গতকাল রবিবার দুপুরে মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, “পরীক্ষা শুরু হওয়ার সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগেই আসল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। তবে পরীক্ষার এক দিন আগে ভুয়া প্রশ্নপত্র ছড়ানো হতো। প্রকৃত প্রশ্নের সঙ্গে এসব প্রশ্নের মিল নেই। কারণ বান্ডেল খোলার আগে এই প্রশ্ন দেখার সুযোগ কারো নেই। কেন্দ্র থেকে পরীক্ষাকক্ষে যাওয়ার সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। পরীক্ষা শুরুর ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগে কোনো ‘দুষ্ট’ লোক মোবাইলে ছবি তুলে গ্রুপগুলোয় ছেড়ে দেয়। এমসিকিউ পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ কাজ বেশি হয়।”

প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বোর্ডের কারো সম্পৃক্ততা এখনো পাননি বলে জানান আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, এই চক্রটির মধ্যে তিন ভাইয়ের ‘উল্লাহ বাহিনী’ ফেসবুকে চ্যালেঞ্জ করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছিল। তারা মূলত মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোতে গ্রুপ ওপেন করে অ্যাডমিন পরিচালনা করত। অনেক ছাত্রকে তারা গ্রুপের সদস্য করত। যেদিন যে পরীক্ষা হবে, সেই পরীক্ষার ভিত্তিতে গ্রুপ খোলা হতো।

ডিবির আরেকটি সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে গোয়েন্দা নজরদারি করে ১৪ জনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়। লেনদেনকারী বিকাশের বেশ কিছু এজেন্ট নম্বর এবং আরো বেশ কিছু পেজ ও গ্রুপও শনাক্ত করা গেছে। তবে যাদের গ্রেপ্তার করা গেছে তারা কেউই সরাসরি প্রশ্ন ফাঁস করেনি দাবি করে বলেছে, প্রশ্ন সরবরাহকারীকে তারা চেনে না। ‘কাটআউট পদ্ধতিতে’ (পরিচয় গোপন করে অপরাধ করে বিচ্ছিন্ন হওয়া) তারা কারবার করছে।

উল্লাহ বাহিনী

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তিন ভাই আমান, বরকত ও আহসান ইন্দিরা রোডের ৮২/খ নম্বর বাসায় থাকেন। বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তরের এনায়েতনগরে। আহসান সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। আমান বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। তিনি ফয়েজ আলম নামে ফেসবুক আইডি থেকে ‘এসএসসি এক্সাম কোয়েশ্চেন ২০১৮’ পেজটি খোলেন। বরকত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র।

এর বাইরে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকার সালাউদ্দিন নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সে ‘জেএসসি কোয়েশ্চেন আউট ঢাকা বোর্ড’, ‘এসএসসি কোয়েশ্চেন আউট’ এবং ‘এইচএসসি কোয়েশ্চন আউট অল বোর্ড’ নামে পেজ চালায়। ‘ইংলিশ ফাস্ট এসএসসি ২০১৮’ নামে মেসেঞ্জার গ্রুপও ছিল তার। সালাউদ্দিন চারটি পেজ থেকে প্রশ্ন পেয়েছে। এগুলো হলো ‘এসএসসি এক্সাম ২০১৮ (পথিক ভাই)’, ‘এসএসসি ইংলিশ (অ্যাডমিন হাবিব)’, ‘ইংরেজি ২য় পত্র ১০০% কমন’ (অ্যাডমিন আদনান খান)’ এবং ‘পিএসসি কোয়েশ্চেন আউট’।

সূত্র মতে, কাফরুলের আলআমিন সরকারি তিতুমীর কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। ‘মেথ কোয়েশ্চেন’ নামে গ্রুপের অ্যাডমিন সে। যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কাজলার রাহাত ইসলাম ‘এসএসসি অ্যান্ড এইচএসসি এক্সাম ২০১৮ অল বোর্ড রিয়েল কোশ্চেন হেল্পলাইন’, ‘এসএসসি এক্সাম ২০১৮ অল বোর্ড রিয়েল কোয়েশ্চেন হেল্পলাইন সেন্টার’ এবং ‘ডিগ্রি অনার্স’স রিয়েল কোয়েশ্চেন হেল্পলাইন সেন্টার’ নামে পেজে প্রশ্ন ফাঁস করছিল।

হাজারীবাগের শেখ রাসেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র আবির ইসলাম নোমান, ফেসবুকে তার তিনটি আইডি। তিনটি গ্রুপে সংযুক্ত হয়ে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়েছে এই কিশোর। টাঙ্গাইলের সুজন স্থানীয় স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী, যে তিনটি পেজ থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করত। শাহাদাৎ স্বপন শেরপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দুটি পেজ ও একটি গ্রুপে সে অপকর্মে জড়ায়। কাফরুলের সুফল সরকারি তিতুমীর কলেজের অনার্সের ছাত্র। এ ছাড়া ফাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এবং তাহসিব নূর মোহাম্মদ রাইফেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র।

ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম সাকলাইন বলেন, আমান উল্লাহর কাছ থেকে দুই লক্ষাধিক টাকা পাওয়া গেছে। তিন ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে আরো টাকা আছে। রাহাত ইসলাম একাই পাঁচটি গ্রুপের অ্যাডমিন। ফেসবুক আইডি আছে পাঁচটি। দুই গ্রুপে সকাল থেকে সে প্রশ্ন সংগ্রহ করে। তিনি আরো বলেন, বিকাশ বা রকেটের পারসোনাল অ্যাকাউন্টে বেশি লেনদেন করা যায় না। সুফল রায় বিকাশের এজেন্টদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল, বলেছিল অনলাইনে ব্যবসা আছে—ক্রেতারা টাকা পাঠাবে। ৬৭ বার বিকাশে লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে তার কাছে। ধরা পড়াদের কেউ বলছে, ফরিদপুরের শিক্ষক প্রশ্ন দিচ্ছে। কেউ বলছে, ‘রাতুল স্যারসহ’ কয়েকটি পেজ থেকে প্রশ্ন আসছে। গ্রেপ্তারকৃতরা অর্ধশতাধিক গ্রুপে সম্পৃক্ত বলে জানান ডিবির কর্মকর্তা।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার ও পরীক্ষার শৃঙ্খলা কমিটির পুলিশের ফোকাল পয়েন্ট শেখ নাজমুল আলম বলেন, ‘যারা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের ধরা হচ্ছে। তদন্ত চলছে। প্রশ্ন ফাঁসকারীরাও ধরা পড়েবে।’

গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে প্রশ্ন ফাঁস খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীরকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এক সপ্তাহ পার হওয়ার পর গতকাল রবিবার কমিটির আহ্বায়ক অফিস আদেশ হাতে পান। অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশের পরও একটিমাত্র আদেশ জারি হতেই সাত দিন সময় লাগল।

জানতে চাইলে কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর বলেন, ‘আমি রবিবার সকাল ৯টায় কমিটির চিঠি হাতে পাই। এরপর বিকেল ৪টায় আমরা প্রথম বৈঠকে বসি। এখন আমাদের দায়িত্ব বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব প্রশ্ন পাওয়া গেছে এর সঙ্গে মূল প্রশ্ন মিলিয়ে দেখা। আমরা এক সপ্তাহ সময় নেব। এর মধ্যে এগুলো মিলিয়ে দেখে ও সঠিকতা যাচাই করে আগামী রবিবার আবার বসব। এরপর দু-এক দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন দিয়ে দেব।’ মো. আলমগীর আরো বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন দেব, সুপারিশ করব। এরপর প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে কি না বা পরীক্ষা বাতিল করা হবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়।’