সম্পাদকীয়

15-12-2017 11:06:36 AM

সাইকেল চালিয়ে মেয়েরা এখন শিক্ষার অগ্রদূত

newsImg

ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল সীমাবদ্ধ। আর সেই সীমাবদ্ধতাকে পাড়ি দিয়ে শিক্ষা অর্জনে নিজেদের এগিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিজেদের কঠিন সামাজিকতার মুখে দাঁড় করিয়ে রক্ষণশীলতার শিকল ছিঁড়ে তারা এখন শিক্ষার অগ্রদূত কিশোরী। বগুড়া সদরের লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নের সাতশিমুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখন ১০ কিলোমিটার সাইকেলে করে স্কুলের ক্লাসে যোগ দিচ্ছে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছে বাইসাইকেলে করে। একজন বা দুজন নয়, স্কুলের শতাধিক মেয়েশিক্ষার্থী নিজেদের বাইসাইকেলে স্কুলে যাচ্ছে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে গ্রামীণ কিশোরীদের বাইসাইকেলই এখন ভরসা। জানা যায়, বগুড়া সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নে সাতশিমুলিয়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৫৭ সালে। গ্রামীণ জনপদে শিক্ষায় এগিয়ে নিতে সাতশিমুলিয়া স্কুলটির বেশ নামডাক রয়েছে। এ স্কুলে শিক্ষার্থী হওয়া গর্বের বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ কারণে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার ঘুরে অনেক শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়ে থাকে।আবার স্কুলের ১৩ কিলোমিটারের মধ্যে আর কোনো হাইস্কুল নেই। তাই অনেকে আবার বাধ্য হয়ে এ স্কুলে শিক্ষা অর্জন করার জন্য নিজেদের নাম লিখিয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছয় শতাধিক। তিন শ’র বেশি মেয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে। এই বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের সহপাঠ চালু রয়েছে শুরু থেকেই। সুনামের সঙ্গে মানসম্মত পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ায় এ বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি। দূরত্ব অনুযায়ী এখানকার শতাধিক ছাত্রী নিজের বাইসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করে। স্কুল শুরুর আগে ছাত্রীদের বাইসাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে আশপাশ। আবার ছুটির সময়ও একই রকম মুখরিত পরিবেশ। স্কুলের ছাত্রীদের পরনে রয়েছে আকাশি রঙের জামা, সাদা পাজামা ও স্কার্ফ। ছাত্রীদের বাইসাইকেলের পেছনে বাঁধা থাকে স্কুলব্যাগ। গ্রামের কিশোরী মেয়েরা প্রতিদিন সাত থেকে আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দল বেঁধে সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। প্রতিদিন বিকাল গড়ালে ক্লাস শেষে স্কুল ছুটির পর সাইকেল চালিয়ে দল বেঁধে ফের বাড়ি ফেরে তারা। বগুড়া সদরের সাতশিমুলিয়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান জানান, চার বছর আগে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আকতার স্থানীয় তেলিহারা গ্রাম থেকে প্রথম বাইসাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসা শুরু করে। প্রতিদিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করত মেয়েটি। সুরাইয়া এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার দেখানো পথেই বর্তমানে বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্রীরা বাইসাইকেলে করে স্কুলে আসে। বিদ্যালয় থেকে অনেকের বাড়ির দূরত্ব ৮ থেকে ৯ কিলোমিটার। দীঘলকান্দি, তেলিহারা, মধুমাঝিরা, নুরইল, দোবাড়িয়া, পীরগাছা, টেগড়া, বিদুপাড়া, রহমতবালাসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। এসব এলাকা স্কুল থেকে অনেক দূরে। প্রতিদিন তো আর সবার পরিবারের পক্ষে ভাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া স্কুলের সড়কটি খানাখন্দে ভরে ওঠায় ঠিকমতো ভ্যানও চলাচল করে না। হেঁটে হেঁটে যাওয়াও অনেক কষ্টকর হয়ে ওঠে। এ কারণে ছাত্রীরা নিজেদের প্রয়োজনেই বাইসাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করছে। ছাত্রীদের বাইসাইকেল চালিয়ে যাওয়া-আসার পর থেকে এ স্কুলে মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। যারা দূরের কারণে স্কুলে আসত না বা বাল্যবিবাহের কবলে পড়ত, এমন কিছু কিশোরীও এখন শিক্ষার প্রতি ঝুঁকে এখানে ভর্তি হয়েছে। সাতশিমুলিয়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী রাফিয়া প্রতিদিন প্রায় আট কিলোমিটার গ্রামীণ পথে সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। তারা দুই বোন। বাবা কৃষিকাজ করেন। বাবাকে খেতের জমিতে কাজ করতে দেখে কৃষিবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন তার। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে প্রতিদিন ৮ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসে সে। এ নিয়ে পথেঘাটে দু-একজন টিপ্পনী কাটলেও সে সবের তোয়াক্কা করে না রাফিয়া। তার মতোই প্রতিদিন ৬ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে আশোকোলা গ্রাম থেকে বিদ্যালয়ে আসে নবম শ্রেণির মেফতাহুল জান্নাত। মেফতাহুল বলে, বাড়ির পাশেও বিদ্যালয় রয়েছে। তবে পড়াশোনার মান ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম ভালো হওয়ার কারণে কষ্ট করে দীর্ঘ পথ সাইকেল চালিয়ে সাতশিমুলিয়া বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে সে। বগুড়া সদরের দোবাড়িয়া গ্রামের অভিভাবক সফিকুল ইসলাম জানান, এলাকায় রাস্তাঘাট দীর্ঘদিন সংস্কার হয় না। যাতায়াতের বাহন শুধু ভ্যানগাড়ি হলেও ঠিকমতো তাও চলাচল করে না। বছরজুড়ে সবজি চাষ হওয়ায় ভ্যানচালকরা ব্যস্ত থাকেন সবজি পরিবহনে। ফলে স্কুলে যাতায়াতের পথে সময়মতো ভ্যানগাড়ি মেলে না শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থী রুহানি আকতার বলেন, ‘স্কুলের সামনের সড়কটি বেহাল। বেহাল সড়কে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। সহজে ভ্যান পাওয়া যায় না। দূরের পথে হাঁটতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। সে কারণে পরিবারের মতামত নিয়ে সাইকেল নিয়ে স্কুল করছি। ’ সাতশিমুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইমরান হোসেন জানান, আশপাশের গ্রামের মেয়েরা ছাড়াও ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকেও মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে এ বিদ্যালয়ে পড়তে আসে। একসময় দীর্ঘ পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে মেয়েদের প্রচণ্ড কষ্ট হতো। এখন সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করায় কষ্ট কমেছে। প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান বললেন, মেয়েদের সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াতকে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সব সময় উৎসাহ দেওয়া হয়। অভিভাবক ও এলাকাবাসীর আন্তরিকতায় মেয়েরা এখন সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করছে। এতে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি বেড়েছে। বগুড়া সদরের লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাফতুন আহম্মেদ জানান, সাতশিমুলিয়া স্কুলের ছাত্রীরা বাইসাইকেলে স্কুলে যাওয়া-আসা করছে। স্কুল থেকে বাড়ি দূরে হওয়ার কারণে ছাত্রীরা সাইকেলযোগেই চলাচল করে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রতিটি অভিভাবককে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে বলা হয়েছে। স্কুলের সামনের রাস্তাটির পিচ-পাথর উঠে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সেটি মেরামত করার জন্য জেলা পরিষদের কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে