বানিজ্য

09-12-2016 11:57:59 AM

২শ ৩শ ৭শ কোটি থেকে এখন ১৭শ কোটি টাকা!

newsImg

২০১২ সালে ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে রাডার ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য একটি আনসলিসিটেড প্রস্তাব পায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করিম অ্যাসোসিয়েটস ওই প্রস্তাব দেয়। পরে ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি মাল্টিমোড সার্ভিল্যান্স সিস্টেম (রাডার) শীর্ষক প্রকল্পটি ৩৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নের নীতিগত অনুমোদন দেয়। ওই ব্যয় পরে বেড়ে হয় ৫৫৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

পিপিপির অংশীদার দরপত্র আহ্বান করলে করিম অ্যাসোসিয়েটস দর দেয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তবে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের পর একই প্রকল্পের ব্যয় আবারো বেড়ে হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। এভাবে কাজ শুরুর আগেই দফায় দফায় বাড়ছে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের ব্যয়।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পুরনো রাডার প্রতিস্থাপনে বেবিচক উদ্যোগ নেয় ২০০৫ সালে। আধুনিক রাডার বসানোর জন্য ডেনিস অর্থায়নে কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আন্তর্জাতিক উপযোগী সিস্টেমসহ রাডার স্থাপনের বিষয়ে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে কনসালট্যান্ট প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনের আলোকে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলে তিনটি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। উন্মুক্ত দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ১০০ কোটি টাকার নিচে এ কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার লক্ষ্যে দরপত্র বাতিল করে বেবিচক। ২০১১ সালের মার্চে দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হলে চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। টেন্ডার দুর্নীতির অভিযোগে রাডার স্থাপনকাজে ডেনিশ অর্থায়ন বাতিল হয়ে যায়। পরে ২০১৩ সালে জাপান সরকারের অনুদানে ১৮০ কোটি টাকায় এ কাজ সম্পন্নের প্রস্তাব দিয়েছিল জাইকা।বেবিচক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়সংবলিত প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বেবিচকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে গঠিত কোয়ালিফিকেশন অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন কমিটি যাচাই-বাছাই করে প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। পিপিপির আওতায় প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনার জন্য আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পরবর্তীতে এটি পাঠানো হবে অর্থ ও ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে। সেখানে অনুমোদন পাওয়ার পর ডিসেম্বরের মধ্যেই দরপত্রের কার্যাদেশ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আধুনিক রাডার স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। বেবিচক থেকে প্রকল্পের একটি আর্থিক মূল্যায়ন মন্ত্রণালয়ে এসেছে। তবে বিস্তারিত আলোচনার আগে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।

জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পিপিপির অংশীদার চেয়ে গত বছর ৮ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। দরপত্র আহ্বানের ২১ দিনের মধ্যে দর জমা দেয়ার কথা থাকলেও প্রায় সাতবার পেছানো হয় এর তারিখ। সর্বশেষ গত ২২ জুন দরপত্র জমা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে গত বছরের ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর সম্ভাব্য ঠিকাদারদের উপস্থিতিতে প্রি-বিড সভা অনুষ্ঠিত হয়। দেশী- বিদেশী ১৭টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। প্রি-বিড সভা শেষে বেবিচক সাইট ভিজিটের তারিখ নির্ধারণ করে।

১৬টি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। গত ২২ জুন দেশী-বিদেশী মোট চারটি প্রতিষ্ঠান দর প্রস্তাব জমা দেয়। এর মধ্যে মেসার্স এরোনেস ইন্টারন্যাশনাল ফ্রান্সের থ্যালেস, মেসার্স করিম অ্যাসোসিয়েটস কানাডার রেডিয়ন, উইংস এভিয়েশন স্পেনের ইন্দ্রা ও চতুর্থ প্রতিষ্ঠান মেসার্স গেকি তোশিবার রাডার স্থাপনের প্রস্তাব জমা দেয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে দুটি প্রস্তাব নন-রেসপন্সিভ হয়। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান কারিগরি মূল্যায়নের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়। দুটি প্রস্তাবের মধ্যে করিম অ্যাসোসিয়েটসকে যোগ্য যোগ্য বলে বিবেচনা করে বেবিচকের কোয়ালিফিকেশন অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন কমিটি।

কমিটির সদস্য ও বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন্স) উইং কমান্ডার চৌধুরী এম জিয়াউল কবির বলেন, মাল্টিমোড সার্ভিল্যান্স সিস্টেম প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

যদিও অনুসন্ধানে জানা যায়, করিম অ্যাসোসিয়েটসের এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই এবং আনসলিসিটেড প্রস্তাব হিসেবে পিপিপি অফিসকে তারা যে প্রস্তাব দেয়, সে প্রকল্পটি আগেই সিভিল এভিয়েশনের তৈরি করা প্রস্তাবের হুবহু অনুকরণ ছিল। করিম অ্যাসোসিয়েটস ২০১২ সালে প্রাথমিকভাবে ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দেয়। তখন এ প্রকল্পের অত্যধিক ব্যয় নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হয়। অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রস্তাবটি ফেরত পাঠায়। অবশেষে করিম অ্যাসোসিয়েটস প্রকল্পের ব্যয় ১৪০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২০১৩ সালের আগস্টে নতুন একটি প্রস্তাব দেয়।

পরে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটি পিপিপির ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সে সময় ব্যয় ধরা হয় ৩৩০ কোটি টাকা। সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী বেবিচক ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর দরপত্রের স্পেসিফিকেশন তৈরির জন্য পিপিপি অফিসের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক কয়েকটি কমিটি করে দেয়। ২০১৪ সালের ২৮ মার্চ রিকোয়েস্ট ফর ইন্টারেস্ট প্রকাশিত হয়। এতে ১০টি দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে। গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) দরপত্রটির ডকুমেন্টের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৮ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো বিমানবন্দরের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রাডার। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকেই সরাসরি রাডারের মতো সংবেদনশীল যন্ত্র সংগ্রহ করে সিভিল এভিয়েশন। পিপিপির মাধ্যমে বিমানবন্দরের ভৌতিক ও সেবামূলক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হলেও কৌশলগত সরঞ্জাম সংগ্রহ, স্থাপনের বিষয়টি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষই করে থাকে।

প্রসঙ্গত, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের গাইডলাইনস অনুযায়ী ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বের সব বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি), এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) ব্যবস্থা বাধ্যতামূলকভাবে যুগোপযোগী করতে হবে। এরই অংশ হিসেবে বেবিচক প্রকল্পটি হাতে নেয়। এ প্রকল্পে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি রাডার স্থাপন, ওয়াইড এরিয়া মাল্টিল্যাটারেশন (ডব্লিউএএম) ও এডিএস-বি স্থাপন, এটিএস সেন্টার আপগ্রেড, কন্ট্রোল টাওয়ার বিল্ডিং স্থাপন, ভিএইচএস, এক্সটেন্ডেড ভিএইচএস, এইচএফ, মাস্টার ক্লক, আরসিএজি, রেকর্ডিং সিস্টেম ও ভিসিসিএস স্থাপন করা হবে। খবর বণিক বার্তা।