15-02-2018 11:25:51 AM

বছরে রপ্তানি কমবে ২৮০০ কোটি ডলার

newsImg

জাতিসংঘের দেওয়া তিনটি শর্তই পূরণ করায় আগামী মার্চ মাসে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রথম জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক সুপারিশ লাভ করবে বাংলাদেশ। এ সুখবরের সঙ্গেই একে একে আসতে থাকবে বাংলাদেশের সামনে বড় বড় চ্যালেঞ্জ। বাড়তি শুল্কারোপের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যাবে বছরে প্রায় দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দুই লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের সুদহার বাড়াসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কমে যাবে বাংলাদেশের আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা। বিদেশি সংস্থার সহায়তায় ফেলোশিপ, স্কলারশিপ, প্রশিক্ষণ সুবিধাও থাকবে না উন্নয়নশীল বাংলাদেশে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের সামনে মোটা দাগে ১৩টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আজ তা মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানে।

জাতিসংঘের শর্তানুযায়ী, ২০১৮ সালে কোনো দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় এক হাজার ২৩০ ডলার বা তার বেশি, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ৬৬ বা তার বেশি এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার কম হলে ওই দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার যোগ্য। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) হিসাবেও বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। তাই আগামী মার্চ মাসে অনুষ্ঠেয় সিডিপির ত্রিবার্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের প্রথম সুপারিশ লাভ করবে বলে আশা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান পর্যালোচনা শেষে ২০২৪ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দেবে।

ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মনোয়ার আহমেদ গতকাল জানান, আগামী মার্চে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের প্রথম আনুষ্ঠানিক সুপারিশ পাওয়ার ব্যাপারে আমরা দৃঢ় আশাবাদী। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশকে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, মোকাবেলা করার জন্য কোন ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন—সার্বিক বিষয় আমরা মন্ত্রিসভাকে অবহিত করব।

মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য ইআরডির তৈরি করা প্রতিবেদনে মোট ১৩টি চ্যালেঞ্জের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা না থাকা। এলডিসি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে, যা ওই বছরের মোট রপ্তানির ৭২ শতাংশ। এ ছাড়া আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায়ও বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায়। সব মিলিয়ে দেশের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশই শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে এ সুবিধা থাকবে না।

রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ বাজার সুবিধাও (স্পেশাল মার্কেট এক্সেস) কমে যাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। আঞ্চলিক বাণিজ্য উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশের পণ্য বিভিন্ন দেশের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে ট্রান্সজিশন শুরুর সময় থেকেই এ সুবিধা কমতে থাকবে। তখন বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য বাড়তি শুল্ককর দিয়ে রপ্তানি করতে হবে। তখন ওই সব দেশে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, যা সেখানকার ক্রেতা হারাতে পারে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৬.৭ শতাংশ শুল্কারোপ করবে বিভিন্ন দেশ। তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৮ শতাংশ কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছে ইআরডি। ২০১৫ সালের রপ্তানি আয় বিবেচনায় এর পরিমাণ দুই হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ৮ শতাংশ হারে হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলার। জাতিসংঘের সংস্থা আংকটাডের হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় ৫.৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ কমে যাবে।

উত্তরণকাল ও উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পর যাতে রপ্তানি ও শিল্প খাত প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়াতে পারে সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ যে সুবিধা পায়, তা না থাকলে কত ক্ষতি হবে, ব্যবসায়ীদের তা হিসাব করতে হবে।

অবশ্য উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরও যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশ ‘জিএসপি প্লাস’ কর্মসূচির আওতায় এ সুবিধা পায়, সে জন্য কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি আশাবাদী যে ইইউ এই সুবিধা দেবে।

এলডিসি হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে স্কলারশিপ, ফেলোশিপ, বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন ধরনের সভা ও ওয়ার্কশপ, গবেষণা সম্পাদন, নীতি বিশ্লেষণে সহায়তা দেওয়া ছাড়াও আন্তঃ সরকার প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর এসব সুবিধা আর থাকবে না।

ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছে, তবু প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি অনিশ্চিত বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পুষ্টির উন্নয়নে এখন যে সহায়তা দিচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর তা আর থাকবে না।

১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট যে পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা পেয়েছে, তার ৯০.৫ শতাংশ ছিল অনুদান, ৯.৫ শতাংশ ছিল ঋণ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার ১২.৫ শতাংশ অনুদান ও ৮৭.৫ শতাংশ ঋণ। অর্থাৎ বিদেশি অনুদান কমছে, ঋণ বাড়ছে। এই সময়ে দ্বিপক্ষীয় অনুদানও ৮৫.৭ শতাংশ থেকে কমে ৩১.৯ শতাংশে নেমেছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি পাওয়ায় বাংলাদেশের বহুজাতিক সংস্থা থেকে সহায়তা নেওয়া বাড়ছে। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বহুজাতিক সংস্থার সহায়তা ছিল মোট সহায়তার ১৪.৩ শতাংশ, ২০১৫-১৬-তে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫.৪ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে এসব সহায়তার বিপরীতে সুদের হার বাড়বে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক তার দেওয়া ঋণ সহায়তার সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে বলে ইআরডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় প্রকল্পগুলোর জন্য আরো বেশি বৈদেশিক ঋণের দরকার হবে, যা এখনকার মতো কম সুদে পাওয়া যাবে না। সুদের হার বাড়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ বাড়তে পারে আশঙ্কা করে এর ব্যবস্থাপনায় কৌশল নির্ধারণ জরুরি বলে উল্লেখ করেছে ইআরডি। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। মানুষ যাতে সঞ্চয় বাড়িয়ে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আয়কর থেকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।

ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারকে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সুবিধাসহ পর্যাপ্ত অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে খরচ কমানোর জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকলেও রপ্তানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি দেখতে হবে। বিভিন্ন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। হতদরিদ্র কমাতে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানো, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যতটা সম্ভব জোরদার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ ও রোহিঙ্গা ঢলের মতো নতুন যেসব সংকট দেখা দেবে, তা মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।