পড়াশুনা, পরীক্ষা ও ফলাফল

24-01-2018 11:54:54 AM

ঢাবির অবরুদ্ধ উপাচার্যকে উদ্ধার করল ছাত্রলীগ

newsImg

নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে হামলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার একপর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দীকেও বেধড়ক মারধর :

 

শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার এবং ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচার দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হামলা-সংর্ঘষের ঘটনা ঘটেছে। উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীরা ফটকের তালা ভেঙে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানকে দুপুর থেকে কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। বিকেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে গিয়ে উপাচার্যকে মুক্ত করে। এ সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকসহ আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক।

আহতদের মধ্যে ৯ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে তাদের আঘাত গুরুতর নয়। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট হামলার প্রতিবাদে আজ বুধবার সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যার আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ক্যাম্পাসে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। উপাচার্যকে মুক্ত করতে কিংবা সংঘর্ষ-উত্তেজনা থামাতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের কোনো সহায়তা চায়নি।

আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করছে, তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে বিনা উসকানিতে ছাত্রলীগকর্মীরা হামলা চালায়। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পাল্টা অভিযোগ করছে, উপাচার্যকে আটকে রেখে আন্দোলনকারীরা লাঞ্ছিত করে। উপাচার্যের শরীরের পোশাক ধরেও টানাটানি করেছে। এটি শুনে নেতাকর্মীরা এগিয়ে গেলে বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল বিকেল ৩টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান অবরুদ্ধ উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁদের সঙ্গে আরো ২৫-৩০ জন নেতাকর্মী ছিল। তারা উপাচার্য কার্যালয়ের পাশে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হন। আন্দোলনকারীরা এ সময় তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। তখন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের হুমকি-ধমকি দেয় এবং পাল্টা স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, আন্দোলনকারীদের হামলায় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন আহত হয়েছেন। আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছাত্রদল নেতারাও অছেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়লে জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের আরেকটি দল সেখানে যায়। এতে আন্দোলনকারীরা আতঙ্কিত হয়ে প্রশাসনিক ভিসি অফিসের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। এতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তারা রড ও লাঠি দিয়ে গেটে আঘাত করতে থাকে। পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রবেশপথ ভেঙে আন্দোলনকারীদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছে, এ সময় ছাত্রলীগ তাদের মারধর করা শুরু করে। 

এ রকম পরিস্থিতিতে আন্দোলনরত ছাত্রীরা দ্বিতীয় তলায় চলে যায় ও প্রশাসনিক ভবনের কক্ষে অবস্থান নেয়।

হামলায় আহতদের মধ্যে আছেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদ লিটন নন্দী, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস, ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির, ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ইভা মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহসভাপতি ও ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মীর আরশাদুল হক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাসুদ আল মাহদি, আবু রায়হান খান, প্রগতি তমা বর্মণ, সাদিক ও রাজিব।

যেভাবে উত্তেজনা : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল দুপুর ১২টায় মিছিল নিয়ে উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও করে আন্দোলনকারীরা। এর আগে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। উপাচার্য কার্যালয়ের প্রবেশপথে দুটি কলাপসিবল গেটের চারটি তালা ও দুটি শিকল ভেঙে তারা ভেতরে প্রবেশ করে অবস্থান নেয়। উপাচার্য বের হয়ে না আসা পর্যন্ত তারা সেখান থেকে যাবে না বলে জানায়। একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় যোগ দিতে বিকেল ৩টার দিকে উপাচার্য কার্যালয় থেকে বের হয়ে এলে ঘিরে ধরে আন্দোলনকারীরা। উপাচার্য তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিচারের আশ্বাস দেন। কিন্তু আন্দোলনকারীর দাবির বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা চেয়ে উপাচার্যকে আটকে রাখে। উপাচার্য আখতারুজ্জামান আন্দোলনকারীদের বলেন, ‘তোমাদের দাবি আমরা জেনেছি। আমরা নিপীড়নকারীদের বরদাশত করব না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মোতাবেক কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থাকবে না। এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময় লাগবে। তোমরা এখন চলে যাও।’

উপাচার্যের বক্তব্যের জবাবে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী বলেন, ‘এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ও প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা জানি এই তদন্তের ফল কী হবে। এই আশ্বাস মানি না। আমরা এখনই সুস্পষ্ট ঘোষণা চাই।  সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া আপনি এখান থেকে যেতে পারবেন না।’ সেখানে উপস্থিত শিক্ষকরা উপচার্যকে তাদের ঘেরাও থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঘটনাস্থলে আসে। ছাত্রলীগের নেতারা এরপর উপাচার্যকে উদ্ধার করে তাঁর কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যান। পরে উপাচার্য সাড়ে ৪টার দিকে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় অংশ নেন।

আন্দোলনকারীদের একজন, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের একটি ঝামেলার কথা শুনে আমি সেখানে যাই। পরিস্থিতি শান্তই ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগ অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। আমাকেও টেনে নিয়ে মারধর করে।’

ছাত্রলীগের বক্তব্য : বিকেলে মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ। সেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিল। সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, দাবি আদায় কখনো ভাঙচুরের মাধ্যমে হতে পারে না। এভাবে জঙ্গি কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার প্রতিবাদ জানাই ও বিচার চাই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করা হবে। সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, ‘আমরা সেখানে গিয়ে দেখি, উপাচার্য নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। যারা হামলা করেছে তাদের বিচার চাই। আমাদের এক দফা এক দাবি, হামলাকারীদের বিচার চাই।’

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে একপর্যায়ে লাঞ্ছিত করে। উপাচার্য তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অসদাচরণ করে। আমরা তাদের শান্ত করার জন্য সেখানে যাই; কিন্তু তারা আমাদের আটকে দেয়। এতে পরবর্তীতে একটি অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সামাল দিতে চাইলেও পারিনি।’

গতকাল এ রকম সংঘাতপূর্ণ অবস্থা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে পুলিশের উপস্থিতি না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহায়তা না চাইলে আমাদের করার কিছু নেই। কারণ পরে কোনো সমস্যা হলে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? সহায়তা চাইলে অবশ্যই ক্যাম্পাসে ফোর্স দেওয়া হবে।’

ছাত্রজোটের আজ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি : বাম ছাত্রসংগঠনের মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ঘটনার প্রতিবাদে আজ বুধবার সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। রাত সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে সংগঠনটি। আজ দুপুর ১২টায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলেও জানায় সংগঠনটি। সমাবেশে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি ও প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক ইমরান হাবিব রুমন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে কলঙ্কজনক দিন আজ। আমরা এই ঘটনায় প্রক্টরের পদত্যাগ ও হামলার সুষ্ঠু বিচার চাই।’

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া ও অপরিকল্পিত অধিভুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে অধিভুক্ত বাতিলের দাবিতে ১১ জানুয়ারি আন্দোলনে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী সময় কয়েকটি হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগে আন্দোলনে যুক্ত হয় বাম ছাত্রসংগঠন। সেই নিপীড়নের বিচার চেয়ে ১৭ জানুয়ারি প্রক্টরের কার্যালয় ঘেরাও করে প্রবেশপথ ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনায় শিক্ষার্থীদের চাপে রাখতে প্রশাসন অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়, এক দফার আন্দোলন তিন দফায় রূপ নেয়। এই দাবিগুলো হচ্ছে মামলা প্রত্যাহার ও প্রক্টরের পদত্যাগ, নিপীড়কদের বিচার ও সাত কলেজ নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। তিন দফা দাবি মেনে নিতে বেঁধে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টা সময় পার হলে গত রবিবার শিক্ষার্থীরা উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ও তদন্ত কমিটি : গতকাল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীনকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন প্রদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচির নামে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও হাতিয়ার ব্যবহার করে উপাচার্য অফিসের তিনটি গেটের তালা ও শিকল ভেঙে হামলাকারীরা উপাচার্যের অফিসকক্ষের সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় তারা উপস্থিত শিক্ষক, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ও উপাচার্যকে উদ্দেশ করে অশালীন বক্তব্য দিতে থাকে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদলকে উপাচার্য মহোদয়ের কাছে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য বারবার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এই আহ্বানে তারা কোনো ধরনের কর্ণপাত করেনি।