আন্তরজাতিক রাজনীতি

15-12-2017 09:44:42 AM

বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে

newsImg

 দিল্লী থেকে প্রকাশিত ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাদেশের রাজনীতি- সমসাময়িক কিছু ঘটনা নিয়ে পর্যালোচনামূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনটি লিখেছেন জয়তী মালহোত্রা। 
পেছনের দিকে তাকালে মনে হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পরিণতির জন্য গত নভেম্বর মাসটি মুখ্য হয়ে উঠতে পারে। ৭ নভেম্বর ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মুবশ্বের হাসানকে কথিত গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তুলে নিয়ে যায়। প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী ও তার দলীয় নেতাদের সমালোচনার পর ১১ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি এস. কে সিনহা তার পদত্যাগপত্র জমা দেন।
সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী, যেখানে শীর্ষ বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া ছিল, তা বাতিলের ‘দুঃসাহস’ দেখানোর কারণে সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধান বিচারপতি। তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়। সেই থেকে তিনি দেশের বাইরে।
অবশ্য গত নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। প্রতিবাদ হিসেবে সে নির্বাচনে অংশই নেয়নি বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা এখন দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করছেন।
এরপর ১২ নভেম্বর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ঢাকার প্রাণকেন্দ্র সোহরাওয়াদী উদ্যানে বিশাল সমাবেশে নেতৃত্ব দেন। রাজধানী এ সময় বেশ কয়েক ঘন্টা অচল হয়ে পড়ে। জবাবে ১৮ নভেম্বর বিশাল শক্তি-প্রদর্শন করেন শেখ হাসিনা। দৃশ্যত যেটার আয়োজন করা হয়েছিল ইউনেস্কো কর্তৃক তার পিতার দেয়া ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অসামান্য ভাষণের স্বীকৃতির উদযাপন হিসেবে।
বাস্তবে সেটা ছিল এক বছরের মাথায় যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটাতে অংশ নেয়ার দুঃসাহস দেখানোর আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়ার ১২ নভেম্বরের সমাবেশের প্রতি পাল্টা চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে তাহলে কি ঘটছে? রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতীয় নেতৃত্বের মিনমিনে ভূমিকার বিপরীতে শেখ হাসিনার পরিশ্রমী তৎপরতা আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়িয়েছে। সা¤প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দিলেও এখনও দরিদ্রপায় একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই জাতিগত নিধনের অভিযোগ করেছেন।
এতে চীন তৎপর হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পৃবিদ্ধি হয়েছে ৭.১ শতাংশ যেটা গত ৩০ বছরের মধ্যে দ্রুততম। অন্যদিকে, টানা ষষ্ঠ বছরের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের উপরে। কিন্তু, ঢাকার কয়েকটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দুঃখ আর বিপর্যয়ের সাথে এই ঝকঝকে চিত্রের পার্থক্য অনেক। গত কয়েক বছরে শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে আলোচনা অনেক বেড়েছে। বরেণ্য সংবাদপত্র ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে ৮২টি মামলা করেছে সরকার। পত্রিকার সম্পাদককে বাধ্য হয়ে সারাদেশের মফস্বল আদালতগুলোতে হাজিরা দিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বাংলা দৈনিক প্রথম আলোও সরকারের আরেকটি প্রিয় টার্গেট। আপাতত কিছুটা শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। তবে, একাধিক সাংবাদিকের মতে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর লম্বা হাত সবসময় আশেপাশেই আছে।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ক্রমেই বাড়ানো হচ্ছে। জনগণের নিরাপত্তার নামে বিশেষ করে গত গ্রীষ্মে হোলি বেকারির ঘটনার পর থেকে নতুন ব্যাটালিয়ন যুক্ত হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে। ক্রমেই আরও শক্তিশালী হচ্ছে সামরিক বাহিনী। শেখ হাসিনাকে দিয়ে চীন থেকে দু’টো সাবমেরিন কেনানো হয়েছে। কোথায়, কেন, কি উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহার করা হবে, সেটা এখনও পরিস্কার নয়। হরহামেশাই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে অপহৃত হচ্ছে মানুষ।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসেবে শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই ৭৪ জনকে গোপনে আটক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেতরের লোকেরাই বলছেন দল বিভক্ত হয়ে গেছে; ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরগুলোতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতি আর ঘুষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
আওয়ামী লীগের ব্যাপারে জনগণ এতটাই অতীষ্ঠ যে বলা হচ্ছে এখন নির্বাচন হলে সংসদের ৩০০টি আসনের (মহিলাদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে আলাদা) মধ্যে হয়তো কোনরকমে ৭৫টি সিট পাবে শেখ হাসিনার দল। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এখনও দুর্নীতির অভিযোগমুক্ত আছেন। তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতোই ছেলে জয়ের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে যেতে চান তিনি। জয়ের যেহেতু তৃণমূল পর্যায়ে খুব সামান্যই প্রভাব রয়েছে, তাই শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও তার ছেলে ববি নামে যিনি পরিচিত, তাদের হাতেই আসল ক্ষমতা অনেকখানি রয়ে গেছে বলে বলা হয়।
তবে বাংলাদেশীরা এটাও বুঝতে পারছে যে শেখ হাসিনা হেরে গেলে এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসলে রাস্তা রাসতায় রক্তের বন্যা বইবে। খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক, যিনি দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন এবং যিনি আপাদমস্তক ভারতবিরোধী; তিনি নিশ্চিতভাবেই দেশে রাজনৈতিক বিভেদ বাড়াবেন এর সবকিছুর জন্য ভারতকে দায়ী করবেন।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গেরিলাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া, চীন-পাকিস্তান বলয়ের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশকে কার্যত একটি সামরিক সমর্থনপুষ্ট স্বৈরাচারী দেশে পরিণত করাই হবে বিএনপির মূল অস্ত্র। নিশ্চিতভাবেই চীনের সাথে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠতা (গত বছর বাংলাদেশ সফরের সময় ২৬ বিলিয়ন ডলারের চেক দিয়ে গেছেন শি জিনপিং), রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাকিস্তানে দূত পাঠানো, উচ্চাকাঙ্খী চীনের বড় বড় প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্কা এবং দেশের প্রথম হিন্দু প্রধার বিচারপতির সমালোচনার বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় নয়াদিল্লি।
অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গিবাদ দমন, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো ভারতের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে ট্রেন ও বাস সার্ভিস পুনরায় চালু এমনকি অভ্যন্তরীণ নৌপথে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ব্যপারে নয়াদিল্লির অনুরোধের জবাবে বিপুল তৎপরতা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পাকিস্তান বেসামরিক শাসন ছেড়ে সামরিক শাসনের দিকে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশকে এই ধরনের পরিণতি থেকে রক্ষার জন্য ভারত যতটা সম্ভব চেষ্টা করবে। সব হিসাব নিকাশে মনে হয় ভারতের কাছে এবং বাংলাদেশের অসন্তুষ্ট মানুষের কাছেও শেখ হাসিনাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
কিন্তু একটা নতুন হিসেব এখনও রয়ে গেছে। ভারত সরকারের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। অক্টোবরে সুষমা স্বরাজের সফরের সময় তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া, যদিও ২০১৩ সালে ঢাকায় ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির সফরকালে তার সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেছিলেন তিনি।(খালেদা জিয়ার আগ্রহ যদি সত্যিকারের হয়, তাহলে তার উচিত হবে রাজনৈতিক উত্তরাধীকার দলের নম্র-স্বভাবের মহাসচিব ফখরুল ইসলামের কাছে দিয়ে যাওয়া)। অন্যদিকে দিল্লির প্রত্যাশা শেখ হাসিনা যাতে অন্তত দৃশ্যমান অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ সুগম করেন। এর অর্থ হলো এখন থেকে এক বছরের মাথায় যে নির্বাচন হবে, তখন বিএনপি যাতে বৈধ বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা নিয়ে যে জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল, সামনের বছরে বোঝা যাবে সেই প্রতিশ্রুতি কতটা রাখতে পেরেছে তারা, ১৯৭১ সালে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। আর এ অঞ্চলের বাকি দেশগুলো ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখবে তাদের উপর।