বাংলাদেশ | শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪ | ৭ বৈশাখ,১৪৩১

জাতীয়

04-01-2018 02:50:30 PM

শীর্ষ সোনা চোরাচালানি নাগাল থেকে উধাও

newsImg

পাসপোর্ট ফেলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে গেছেন শীর্ষ সোনা চোরাচালানি মতিয়ার রহমান ওরফে খলিল। গত ২৫ ডিসেম্বর সকালে শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তিনি কলম্বো যাচ্ছিলেন। তাঁর বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এই মতিয়ার রহমান গত তিন বছরে (২০১৫-১৭ সময়ে) ১৬৫ বার বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় ৭৮ বার, আর ভারতে ৬৪ বার। দুবাই, কলম্বো, হংকং ও সিঙ্গাপুরেও তিনি কম যাননি। এতবার বিদেশে গেলেও কখনো তাঁকে কোনো জেরার মুখে পড়তে হয়নি। বরং অভিবাসন পুলিশ সব সময় তাঁকে ছাড় দিয়ে গেছে। এবার মতিয়ার রহমান বিপদে পড়েছেন সিঙ্গাপুরের কারণে। তবে এবারও পুলিশ সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে যান তিনি।

বাংলাদেশ হচ্ছে সোনা চোরাচালানের একটি বড় রুট বা পথ। প্রায় প্রতিদিনই পাচার হয়ে আসা সোনা ধরা পড়ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে। সোনা পাচারের সময় এর বাহকেরা কখনো কখনো ধরা পড়লেও এর মূল মালিক বা অর্থলগ্নিকারী ব্যক্তিরা ধরা পড়েন না। তাঁরা সব সময়ই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে এই প্রথম সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পরও শীর্ষ এই চোরাচালানিকে পুলিশ ধরতে পারেনি। পুলিশের সূত্রগুলোই সন্দেহ করছে, তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখার (এনসিবি) একজন কর্মকর্তা  বলেন, সিঙ্গাপুর ইন্টারপোল গত বছরের ৩১ আগস্ট সে দেশের পুলিশের করা অবৈধ মুদ্রা পাচারের একটি ঘটনার তদন্তের ব্যাপারে বাংলাদেশকে জানায়। এতে বলা হয়, সিঙ্গাপুরে কাজের অনুমতি পাওয়া শ্রমিক আলাউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম ওই বছরের ১৭ জুলাই বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা নিয়ে সিঙ্গাপুরে ধরা পড়েন। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানান, এই অর্থের মালিক মতিয়ার রহমান নামের এক ব্যক্তি, যিনি সিঙ্গাপুর থেকে সোনার চালান বাংলাদেশে নিয়ে যান। আলাউদ্দিন এর আগেও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে সিঙ্গাপুরে আসার কথা সিঙ্গাপুরের পুলিশের কাছে স্বীকার করেন। এরপর সিঙ্গাপুর পুলিশের বাণিজ্যবিষয়ক শাখা এ ঘটনার তদন্ত করে।

সিঙ্গাপুর পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, মতিয়ার রহমান বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা (ডলার) বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে আসছেন। এরপর সেই ডলার দিয়ে সোনা কিনে তা আবার বাংলাদেশে পাচার করছেন। মতিয়ারের এই সোনার কারবারের সঙ্গে আলাউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম ছাড়াও রেজাউর রহমান, মমিনুর রহমানসহ অনেক লোক জড়িত বলে সিঙ্গাপুর পুলিশ জানতে পারে। সিঙ্গাপুর পুলিশের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাগজে-কলমে মতিয়ার ও আলাউদ্দিনের ঢাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে বলে জানালেও সিঙ্গাপুর থেকে সোনার বড় বড় চালান বাংলাদেশে পাচার করাই তাঁদের প্রধান কাজ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা এই কাজ করছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।

ইন্টারপোলের এই প্রতিবেদন তদন্তের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন শাখায় পাঠানো হয়। সিআইডির পক্ষ থেকে অভিবাসন পুলিশের কাছে ওই পাঁচজনের পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে তাঁদের আটকের জন্য অনুরোধ করা হয়। এই অবস্থায় ২৪ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের (ইউএল-১৮৯) বিমানযোগে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে কলম্বো থেকে ঢাকায় আসেন মতিয়ার। তারপর তিনি নির্বিঘ্নে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যান।

ইমিগ্রেশন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা  বলেন, ২৪ ডিসেম্বর সকালে মতিয়ার কলম্বো থেকে ঢাকায় ফেরেন। পরদিন ২৫ ডিসেম্বর আবার তিনি কলম্বো যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে আসেন। এরপর শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের বিজনেস শ্রেণিতে আসন নেওয়ার পর ইমিগ্রেশন করার জন্য পাসপোর্ট জমা দেন। তাঁর পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তিনি তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর অবস্থা বুঝে মতিয়ার বাথরুমে যাওয়ার ভান করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যান।

বিমানবন্দরের ভেতরে অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মতো স্পর্শকাতর স্থান থেকে একজন সোনা চোরাচালানি কীভাবে পালাতে পারেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিস্থিতি বুঝে ওই সোনা চোরাচালানিকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়েছে। তবে ইমিগ্রেশন পুলিশের দাবি, ওই সময় পর্যন্ত তাঁর নামে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। মতিয়ারের নামে নিষেধাজ্ঞা নথিভুক্ত হয় ওই দিন বেলা সাড়ে তিনটায়।

 পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ এ বিষয়ে  বলেন, বিমানবন্দরের সর্বত্র ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা রয়েছে। এটা দেখলেই সহজে বোঝা যাবে, কেউ এই চোরাচালানিকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন, নাকি তিনি নিজেই পালিয়েছেন।

মতিয়ার রহমানের বাড়ি টঙ্গী থানার পাশে তিস্তা গেটের মরকুন এলাকায়। তবে বেশির ভাগ সময়ই তিনি বিদেশে থাকেন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি বড় ব্যবসায়ী, সে কারণে দিনরাত দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, সোনা চোরাচালানি চক্রের প্রধান মতিয়ারকে অনেক দিন থেকেই খোঁজা হচ্ছে। তিনি বিমানবন্দরে এলে তাঁকে যেন আটক করা হয়, সে ব্যাপারে দাপ্তরিক অনুরোধ করা হয়েছিল।

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সোনা চোরাচালানের জন্য ঢাকায় যে সাত থেকে আটটি সিন্ডিকেট রয়েছে, তারই একটি নিয়ন্ত্রণ করেন এই মতিয়ার। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে কোটি কোটি ডলার তিনি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে পাচার করেন। সেখান থেকে সোনা কিনে তা বাংলাদেশ হয়ে আবার ভারতে পাঠান।

সিআইডির বিশেষ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম  এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘মতিয়ার গোল্ড স্মাগলিংয়ের রিং লিডার।’

কে এই মতিয়ার

টঙ্গীর মরকুন এলাকার তিস্তা গেট মসজিদের পাশে গেলে এলাকার লোকজন জানান, মতিয়ার এলাকায় খলিল নামে পরিচিত। সিঙ্গাপুর পুলিশের তালিকাভুক্ত রেজাউল করিম তাঁর সন্তান। বাবা-ছেলে মিলে সোনার কারবার করেন। এলাকার মসজিদের এক মুসল্লি বলেন, পাশেই হেলাল উদ্দিনের দোকানের পেছনে মতিয়ার আলিশান বাড়ি তৈরি করছেন। মতিয়ারের ছেলে রেজাউল দিনে একবার এসে কাজ দেখে যান। পাশের এক দোকানি এ সময় বলেন, ‘রেজাউল আশপাশেই ছিল, আপনাকে দেখে চলে গেল। তারা এখন উত্তরায় থাকে।’ তাঁদের ফোন নম্বর নিয়ে বারবার চেষ্টা করেও কারও সাড়া মেলেনি।

টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ তালুকদার  বলেন, এলাকায় মতিয়ারেরা নেই, তাঁদের খোঁজ করা হচ্ছে। সিআইডি পুলিশও তাঁদের খুঁজছে। তাঁরা নামকরা সোনা চোরাচালানি বলে তিনি শুনেছেন।

মতিয়ার রহমানের ব্যাপারে খোঁজ করে জানা গেল, আশির দশকে তিনি ‘লাগেজ ব্যবসা’ করতেন। ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া থেকে কসমেটিকস, ঘড়ি ও অন্য জিনিসপত্র এনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন। পরে তিনি কিছুদিন মোবাইল ফোন আনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই পরিচিতি ও যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে শুরু করেন সোনা চোরাচালান। সোনার কারবার করে তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান  বলেন, এই চক্রের ব্যাপারে অধিদপ্তরও খোঁজখবর করছে।

দেশ-বিদেশে সিন্ডিকেট

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সোনার কারবারের জন্য দুনিয়াজুড়ে মতিয়ারের সিন্ডিকেট রয়েছে। এর মধ্যে দুবাইয়ের এমরান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক মোহাম্মদ এমরান, কলকাতার সোনা চোরাচালানি আসিফ আহমেদ, অজিত, গোবিন্দ, বিজন হালদার, লক্ষ্মণ, গোপাল, কৃষ্ণ কুমার দাস ও সিঙ্গাপুরের সোনার ব্যবসায়ী স্টিফেনের সঙ্গে তাঁর যোগসাজশ রয়েছে।

মতিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাই থেকে সোনার চালান বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ওই সব দেশে কর্মরত শ্রমিকদের মাধ্যমে। সিঙ্গাপুরের শ্রমিক মানিকগঞ্জের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমকে তিনি এ কাজে ব্যবহার করতেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, তাঁতীবাজারের পঙ্কজ, বাবু, ফরহাদ, উজ্জ্বল, রাজীব, বিশ্বজিৎ, বজলু, মামুন ও মোবারকের মাধ্যমে এর আগে মতিয়ারের সোনার চালান খালাস হয়েছে বলে তাঁরা জেনেছেন। মতিয়ারের সঙ্গে ঢাকার আমিন মানি এক্সচেঞ্জের শামসুদ্দিন, সিটি মানি এক্সচেঞ্জের কামরুল ইসলাম, ভাই ভাই মানি এক্সচেঞ্জের মিজানুর রহমান টিপু, প্যারামাউন্ট মানি এক্সচেঞ্জের মালিক জাহাঙ্গীর, ঢাকা মানি এক্সচেঞ্জের মালিক নবী নেওয়াজ খানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার তথ্য রয়েছে।

খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, চোরাচালানের সহযোগী জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি মানিকগঞ্জের ঘিওরে। তাঁর বাবা আবদুল আলিম  বলেন, চার বছর ধরে জাহাঙ্গীর সিঙ্গাপুরেই অবস্থান করছেন। মাঝেমধ্যে দেশে টাকা পাঠান। সেখানে ছেলে কী করেন, তা তিনি জানেন না।

আরেক সহযোগী আলাউদ্দিন থাকেন কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের বাবুরকান্দিতে। সেখানে গেলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি এড়িয়ে যান। পরে টেলিফোনে বলেন, সিঙ্গাপুরের ব্যবসা তিনি আর করেন না। ঝামেলা হওয়ার কারণে বন্ধ করে দিয়েছেন। কী ঝামেলা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৭ সালে দেশে ৬৯১ কেজি সোনা পাচারের সময় জব্দ করা হয়েছে। এর বাজারমূল্য ৩৩৬ কোটি টাকা। এ সময় ৪৯টি মামলায় ৭৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাঁদের সবাই চোরাই সোনার বাহক। কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যত সোনা ধরা পড়ছে, তার কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হয়ে যায়। ধরা পড়ে সামান্যই।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীব-উল আলম  বলেন, সোনা পাচারের ঘটনার সঙ্গে দুটি বাহিনী জড়িত। একটি কাস্টমস, আরেকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কাস্টমসের কাছে বস্তুটাই মুখ্য, ব্যক্তিটা গৌণ। কে সোনা আনল, তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা কম। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে মুখ্য ব্যক্তি। সোনা পাচারের নেপথ্যের যে ব্যক্তি, তাকে খুঁজে বের করা দায়িত্ব পুলিশেরই। কিন্তু তারা চরম গাফিলতি করে।

খবরটি সংগ্রহ করেনঃ- আই-নিউজ২৪.কম
এই খবরটি মোট ( 297 ) বার পড়া হয়েছে।
add

Share This With Your Friends