বাংলাদেশ | বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪ | ১০ বৈশাখ,১৪৩১

রাজধানী

19-10-2016 04:06:35 PM

মাইক্রোবাস কেটে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা

newsImg

ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্স চালানো বেআইনি। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে অনেকেই এ আইন ভেঙে অ্যাম্বুলেন্সের মতো জরুরি সেবা নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। আবার বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সই আসলে অ্যাম্বুলেন্স নয়। মাইক্রোবাস কেটে অ্যাম্বুলেন্স বানানো হয়েছে।

বিআরটিএর আইন অনুযায়ী, রোগী ও লাশ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স পরিবহনে যে নিবন্ধন দেওয়া হয়, সেটি সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ রাজধানীর তিনটি সরকারি হাসপাতালে রোগী বহনে অন্তত ১০৫টি অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে বলে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের মালিক হাসপাতালের কর্মচারী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।

গত শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান ফটকে রোগীসহ চারজনকে চাপা দেওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি ছিল ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এটির মালিক মাহফুজুর রহমান, যিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড বয়। তাঁকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। এ ঘটনায় অ্যাম্বুলেন্সটির চালকের সহকারী সোহেল মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, অ্যাম্বুলেন্সটির বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল না।

বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (অভিযান) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই মাইক্রোবাসের জন্য লাইসেন্স নেন। এরপর সেটিকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে রোগী বা লাশ বহন করছেন। আইন অনুযায়ী এটি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাইক্রোবাসটির লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। এ ছাড়া বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে বিআরটিএর ঢাকা বিভাগের লাইসেন্স বিভাগের সহকারী পরিচালক সানাউল হক বলেন, এমন তথ্য তাঁর মনে পড়ছে না। তিনি বলেন, অ্যাম্বুলেন্স চালাতে হলে রোগী শোয়ার স্থায়ী শয্যা (পর্যাপ্ত), অক্সিজেন সিলিন্ডার-মাস্ক, চিকিৎসক বসার ব্যবস্থা, স্ট্রেচার ও সাইরেন বসাতে হবে। যাত্রী বহনের আসন বসানো যাবে না। এসব শর্ত সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানকে অ্যাম্বুলেন্সের লাইসেন্স দেওয়া হয়। লাশ বহনেও প্রতিষ্ঠানকে অনুরূপ শর্ত পূরণ করতে হয়। এসব শর্ত ভাঙলে প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে কারণ দর্শাতে বলা হয়। পরে অর্থদণ্ড ও লাইসেন্স বাতিল পর্যন্ত করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, বিআরটিএর একশ্রেণির অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে এই বেআইনি ব্যবসা চলছে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালগুলোর সামনে সারি সারি করে আবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্সের আধিক্য।
পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দেখা যায়, ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত অন্তত ২০টি অ্যাম্বুলেন্স ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। জানা গেল, এসব অ্যাম্বুলেসের মালিক হাসপাতালের আয়া, ওয়ার্ড বয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা। সেখানে সোয়ান অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের কাছে গেলে এগিয়ে আসেন এক যুবক। বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স লাগবে নাকি?’ গাড়িটি কার জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা মো. সোহেলের (স্থানীয়)। সারা দেশে তাঁরা এই অ্যাম্বুলেন্সে রোগী ও লাশ বহন করেন। মাইক্রোবাস কেটে অ্যাম্বুলেন্সটি বানানো হয়েছে বলে জানান যুবকটি।
দেখা যায়, লক্কড়ঝক্কড় এই অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মাস্ক নেই। রোগী শোয়ার মতো একটি ট্রলি বসানো আছে। সেটিতে যাত্রী টানারও আসন রয়েছে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অ্যাম্বুলেন্সচালক মো. দিদার ও আরেকজন মিলন। তাঁরা বলেন, হাসপাতালের চত্বরে থাকা প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস সারা দেশে রোগী ও লাশ বহন করে।
আরেকজন গাড়িচালক (ঢাকা মেট্রো ছ-৭১-২০২৪) মো. আসাদ জানালেন, তাঁর অ্যাম্বুলেসের মালিকের নাম জুম্মন আলী। লাইসেন্স আছে বলে দাবি তাঁর। অ্যাম্বুলেন্সটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও চিকিৎসক বসার সিট নেই কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ (ছাড়পত্র) করা রোগী ও লাশ বহন করি। রিলিজ করা রোগীর অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগে না। তাই রাখা হয়নি।’

হাসপাতালের একজন কর্মচারী নেতা বলেন, হাসপাতালের দাপুটে কর্মচারী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা রোগীদের জিম্মি করে ব্যবসা করছেন। বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্সকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উত্তর প্রান্তের মাঠে দেখা যায় ২০টি অ্যাম্বুলেন্স পার্ক করা। এসব ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এসএস অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের চালক মো. ইমন বলেন, সুপার জেল ব্র্যান্ডের মাইক্রোবাসটি কেটে অ্যাম্বুলেন্স করা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সটির মালিক আবু তাহের। দেখা যায়, অ্যাম্বুলেন্সটিতে যাত্রী বসার সিট আছে কয়েকটি। রোগী শোয়ার স্থায়ী শয্যা ও অ্যাম্বুলেন্স সিলিন্ডার নেই কেন জানতে চাইলে ইমন বলেন, রোগী ট্রলিতে রাখা হয়। ওই ট্রলিতে থাকা রোগীকে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

 ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে আগের মতো রাখা ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্সগুলো নেই। গত শনিবার হাসপাতালের কর্মচারীর অ্যাম্বুলেন্স নামধারী একটি মাইক্রোবাসের ধাক্কায় শিশু, অন্তঃসত্ত্বা মাসহ চারজন নিহত হওয়ার পর এসব গাড়ি এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের কর্মচারী, আওয়ামী লীগের নেতা ও আশপাশের বাসিন্দাদের অন্তত ৬৫টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।

বিআরটিএর জ্যেষ্ঠ পরিদর্শক (যানবাহন) এম এ জলিল প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে রাখা অ্যাম্বুলেন্সগুলো আসলে মাইক্রোবাস। অ্যাম্বুলেন্স চালানোর জন্য এগুলোর কোনো নিবন্ধন করা হয়নি। একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালাতে গিয়েছিলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত পৌঁছানোর আগেই গাড়িগুলো নিয়ে চালকেরা সটকে পড়েন।

বিআরটিএ সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবুল বাশার গতকাল বলেন, অ্যাম্বুলেন্স নামধারী অনেক মাইক্রোবাসের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাতে যান। কিন্তু ভেতরে মুমূর্ষু রোগী থাকায় মানবিক কারণে তাঁরা এসব গাড়ি আটকান না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি চক্র অবৈধ অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

খবরটি সংগ্রহ করেনঃ- i-news24.com
এই খবরটি মোট ( 162 ) বার পড়া হয়েছে।
add

Share This With Your Friends